সময়ের নাটাইয়ে স্মৃতির ঘুড়ি
দেশটা এক ডানাভাঙা পাখির মত বুক ভরা আশা আর শরীরে অজস্র ক্ষত নিয়ে যখন উড়ে বেড়াচ্ছে, আমি তখন যাত্রা শুরু করলাম পুরনো দিনের পথে। চোখ বন্ধ করতেই স্মৃতিরা হেসে উঠল, আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুলের দরজায়। মনে হল, সোনার কাঠি, রুপার কাঠির ছোঁয়া দিলেই স্কুলটা জেগে উঠবে, আমাকে ডেকে বলবে, আয় রে, একদিনের জন্য হলেও ফিরে আয়। আমার প্রাণের স্কুলের অগুনতি স্মৃতি আজো ক্ষণে ক্ষণে আমার গালে নাক ঘষে, আদুরে বেড়ালের মত গুটিসুটি মেরে আমার পাশ ঘেঁসে বসে একটু উষ্ণতার জন্য।
মনে পড়ে যায় স্কুল ক্যান্টিনের কথা। প্রথম ক্যান্টিনটা ছিল মূল ভবনের নিচ তলায় পেছনের দিকে। ছোট্ট একটা ঘর সিঙ্গারা, সমুচার গন্ধে ম ম করত। টিফিন শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগে না গেলে খাবার পাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। ছোট্ট রুমে গাদাগাদি করে সবাই মামা মামা করে চিৎকার করছে আর ক্যান্টিনের গণ-মামারা সবাইকে ব্যস্ত হয়ে বাদামি কাগজের ঠোঙ্গায় খাবার দিচ্ছে- এ ছিল নিত্যদিনের দৃশ্য। খাবার নিয়ে ক্লাসে ফিরে আসতে আসতে ততক্ষণে বাদামি ঠোঙ্গা, হাত সব তেলে মাখামাখি হয়ে যেত। তবু ঐ একটা সিঙ্গারা ৪/৫ জন ভাগাভাগি করে খেত। সেই ঠা-া সিঙ্গারার সামনে বাসার সব নাস্তা ফেল। আর এক কামড় খেলে পানিতে পড়তে হবে, তাই সবাই বাধ্যতামূলকভাবে দুই কামড় খেত। যদিও আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে কেন একবার খেলে পানিতে পড়তে হবে, এবং পানিতে কি নিজে নিজে পড়ব, নাকি কেও পেছন থেকে একটা জুতসই ধাক্কা দেবে।
স্কুল জীবন আর কলেজ জীবন দুটোই কেটেছে এই প্রতিষ্ঠানে। স্কুল বলতেই চোখে ভাসে সকালের পিটি, ক্লাসে পেছনে বসে চিঠি চালাচালি আর স্কুলের মাঠে খামাখা দৌড়াদৌড়ি। আর ছিল মূল্যায়ন পরীক্ষার ঝুম বৃষ্টি, ক্লাস ফাইভে আর এইটে। মনে পড়ছে, রোকেয়া আপা, মাহবুবা আপা, মঞ্জুয়ারা আপা, খাদিজা আপা, মোখলেস স্যার, মাহবুব স্যার, মফিজ স্যারের কথা। ভূগোলের জাদুকর ইকবাল স্যার, বিশ্বের সব দেশের বৃত্তান্ত ঠোঁটের আগায়। স্বচ্ছ কাচের মত নূরুল ইসলাম স্যারের গল্প-কবিতা বলা, বাংলা সাহিত্যের তেতোমিঠে স্বাদ নিতে শেখালেন তিনি। এইম ইন লাইফ জিজ্ঞেস করলে সবাই ডাক্তার হতে চাইত, কোন দিন ক্লাস আগে ছুটি হলে সবার মধ্যে প্রবল উত্তেজনা দেখা দিত। তখন সবচে সাহসের কাজ ছিল দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে বিডিআরের সুইমিং পুলের কাছে যাওয়া।
ডিসেম্বর মাস এলেই শুরু হত বিজয় দিবসের প্যারেড আর ডিসপ্লে। প্যারেড ও ডিসপ্লে ফাঁকি দেওয়ার ১০১ টি উপায়, এই ধরনের বই লেখার ক্ষমতা ছিল স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রীর। যদিও সবাই করুণভাবে ধরা পড়ত বেশির ভাগ সময়। স্কুলের এক দিকের সিঁড়ি দিয়ে আসাদ স্যার চিকন বেত ঘুরাতে ঘুরাতে উঠছেন আর ছোটখাট হুঙ্কার দিচ্ছেন- এটা ছিল ডিসেম্বর মাসের প্রায় প্রতিদিনের চিত্র। স্যার যখন বিল্ডিঙের দোতলায়, পলায়নরত ছাত্র ছাত্রী তখন তিন তলায়।
কিছুক্ষণ এই লুকোচুরি খেলার পর অপরিসীম দক্ষতার সাথে স্যার বেঞ্চের নিচ থেকে, বাথরুমের দরজার পাশ থেকে, সিঁড়ির কোণা থেকে অপরাধীদের ধরে নিচে নিয়ে আসতেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই অপরাধীর প্রমোশন হত গার্লস স্কাউট বা গার্ল গাইডসের সদস্য হিসেবে। আধ ঘণ্টা পর দেখা যেত সেই সদস্য মাঠের কোণায় বসে কচি ঘাস চাবাচ্ছে (স্কাউটে শেখান হয়েছিল শরীরের কোন জায়গা কেটে গেলে রক্ত বন্ধ করার জন্য কচি ঘাসের রস লাগাতে হয়)। নয়ত যেতে হতডিসপ্লে বা প্রশান্ত স্যারের পরিচালনায় লাঠি খেলায় (সরি, খেলাটার আসল নাম মনে করতে পারছি না, শুধু মনে পড়ছে মেয়েরা গোল হয়ে দাঁড়াত, সবার হাতে দুটো করে ছোট লাঠি থাকত)।
স্কুলে একবার ম্যাগি নুডুলসের পক্ষ থেকে নুডুলস খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হল। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। সবার হাতে কাগজের বাটি ধরিয়ে দিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। তারপর সবার বাটিতে একচামচ ফ্রি ধোঁয়া ওঠা নুডুলস স্যুপ দিল। মাঠে তখন শন পাপড়ির মত ঘিয়া রঙের রোদ আর মাঠের পাশে ম্যাগির হলুদ রঙের ভ্যান। কিন্তু স্যার বললেন, বাটি নিয়ে ক্লাসে চলে যেতে হবে।
প্রথমে কিছুক্ষণ সবাই রাগারাগি করলাম, এইভাবে নুডুলসের জন্য লাইনে দাঁড়াতে প্রেস্টিজে লাগে। নুডুলস পাওয়ার পর রাগ করলাম- এত অল্প দিল।
আজো চোখে ভেসে ওঠে স্কুলের বাগানের রাশি রাশি ফুল। গেট দিয়ে ঢুকতেই ডানদিকের বাগানে হেসে উঠত একরাশ গাঢ় নীল অপরাজিতা, সাথে যোগ দিত থোকা থোকা হলুদ কমলা গাদা ফুল আর ছোট্ট ছোট্ট গোলাপি রঙের নয়নতারা। স্কুলে আমাদের প্রিয় খেলা ছিল নয়নতারার পাপড়ি নখে লাগানো, নরম নরম পাপড়ির নখ পরে গান গাইতাম “আমাদের দেশটা স্বপ্ন পুরী, সাথি মোদের ফুল পরী ...। পশ্চিমদিকের বাগানে ছিল লাল লাল জবা আর স্থল পদ্ম। একদিন ম্যাডাম বললেন, আজ ফুলের বিভিন্ন অংশ শেখাব, যাও বাগান থেকে জবা ফুল নিয়ে এস। আমরা দুজন ছুটলাম জবা ফুল ছিঁড়তে। ফুল ছিঁড়ছি আর দূর থেকে দেখে দারোয়ান ভাই ছুটে আসছে। চিৎকার করে বললাম...আরে প্র্যাকটিকালের জন্য তো, দারোয়ান ভাই, ম্যাডাম বলেছে। দারোয়ান বিশ্বাস আর
অবিশ্বাস মেশানো চোখে তাকিয়ে রইল আর আমরা বিজয়ীর ভঙ্গিতে ফুল নিয়ে ক্লাসে চলে গেলাম।
কলেজের দিনগুলো ছিল রংধনুর মত, প্রতিটি দিন নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা আর অনেক অনেক দুষ্টুমি।
কলেজ শিফটে এসেম্বলিতে জাতীয় সঙ্গীত গাইত সবাই যদিও ...“আমি তোমায় ভালবাসি” এই অংশে এসে ছেলেদের গলার আওয়াজ একটু বেশি-ই শোনা যেত। হারুন স্যার ফিজিক্সের হাজারো তত্ত্ব পানির মত করে বোঝাতেন। কামাল স্যার ফিজিক্সের সাথে সাথে ছাত্র ছাত্রীদের নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, নিষ্ঠার মত অমূল্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনে সহায়তা করতেন- সোজা বাংলায়- পুলাপান রে দৌড় এর উপর রাখতেন। ক্লাসের ছেলেদের চুল ছোট রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে কামাল স্যার এর একটা অব্যর্থ টোটকা ছিল- প্রায়ই তিনি ঘোষণা দিতেন, যদি কোন ছেলের মাথার চুল লম্বা রাখে, তাহলে ক্লাসের সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে তিনি কাঁচি কিনবেন আর সেই চুল কেটে দেবেন। বলাই বাহুল্য, এই হুমকির পর ছেলেরা সাবধান থাকত। মজার ব্যাপার হল, অতশত হুমকি ধামকি দিয়েও সবার মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছিলেন কামাল স্যার।
ক্লাস বাদ দিয়ে পেছনের প্রাইমারী স্কুলের নিচু দেয়াল টপকে কে কে পালাল, ঠিকমত পড়াশোনা করছে কিনা সবাই, এইসব দিকে তীক্ষè দৃষ্টি ছিল ক্লাস টিচার সুব্রত স্যারের। একটা সাধারণ কথা বলার সময়ও স্যারের অসাধারণ শব্দচয়ন আমাদের মুগ্ধ করত। ফলাফল- সুদর্শন একজন স্যার কাব্যিক ভাষায় আমাদের বকা দিচ্ছেন, আর আমরা তন্ময় হয়ে শুনছি।
জীবনে প্রথম ব্যাঙ-এর পরিপাকতন্ত্র দেখার জন্য বায়োলজি ল্যাবে গিয়েছি। ব্যাঙ কাটা শেখানো হবে শুনে সবাই একটু আধটু ভয় পাচ্ছে। আমার এক বন্ধু বলল- এইটা আর এমন কি, এইসব আমার কাছে ব্যাপার না। ব্যাঙ কাটা শুরু করতেই ও একটা ওয়াক শব্দ করে দৌড় দিল। পরে আমরা সবাই ওকে খেপানো শুরু করলাম আর ও শুকনা মুখে বার বার দাবী করতে লাগল- নারে আজকে আমার কেমন যেন জ্বর জ্বর লাগছে। ঘটনাচক্রে সেই ভদ্রলোক আজ একজন সফল চিকিৎসক।
কলেজের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া হল গাজিপুরের নাহার গার্ডেনে। সেখানে গিয়ে দেখি শহরেরর ধুলো ভরা মাটিতে কাচাপাকা ঘাসের বিছানা, আর চারপাশে সারি সারি গাছ। ডারউইনের থিওরি প্রমাণ করার জন্যই বোধহয় কিছু ছেলে তর তর করে গাছে উঠে পড়ল। এর মধ্যে টিচাররা ঘোষণা দিলেন, ছেলেরা আর মেয়েরা আলাদা পিকনিক করবে। এবার হাসির হুল্লোড়
উঠল। তবু মজা কম হয়নি। র্যাফেল ড্র তে একজন স্যার (মনে হয় নূর হোসেন স্যার, তখন তিনি মাত্র প্রতিষ্ঠানে এসেছেন) বড় একটা বালতি জিতলেন। ট্রফির মত দুই হাতে ধরে সেই বালতি নিয়ে স্যার বিজয়ীর ভঙ্গিতে একটা দৌড় দিলেন।
স্কুলের বিল্ডিঙে প্রাণসঞ্চার করেছিল আমাদের শ্রদ্ধেয় টিচাররা, হাজারো ছাত্র ছাত্রীরা। মুখচোরা ছাত্র/ ছাত্রীটা স্কুলে এসে মুখর হয়ে উঠত, দুষ্টু মেয়েটা রোকসানা ম্যাডমের সামনে টু শব্দ করত না। কে কোন বছরে বাংলায় কত পেয়েছে, রোকসানা ম্যাডামের মুখস্থ ছিল। আফসার স্যার, আক্তার স্যার, আকমল স্যারের মুখ অন্ধকার হলেই ছাত্ররা সাবধান হয়ে যেত, বকা দেওয়ার প্রয়োজন হত না। স্কুল আলোকিত হয়ে থাকত আমাদের স্বপ্নের ফানুস দিয়ে, মুখরিত হয়ে থাকত আমাদের নিত্যদিনের খুনসুটি দিয়ে আর মাঝে মাঝে নড়ে চড়ে উঠত আমাদের পায়ের শব্দে।
স্কুলের স্মৃতি অসমাপ্ত রয়ে যাবে যদি প্রিন্সিপাল স্যারের কথা না বলি। আজো কোন এক রাংতা পরা ভোরে স্কুলে কান পাতলে শুনতে পাবেন আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারের গগনবিদারী হাসির শব্দ। প্রাণখোলা এই মানুষটা সারাজীবন স্কুলের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাওয়া খাওয়া ভুলে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। বাবা হয়ে আগলে রেখেছিলেন ছাত্র
ছাত্রীদের, শাসনে সোহাগে ভরিয়ে রেখেছিলেন সবাইকে। সবার অভিযোগ, অনুযোগ, আবদার হাসিমুখে শুনেছেন কিন্তু নিজের জন্য কখনো কিছু চান নি। স্কুলের উন্নতির কথা বলতে বলতে তার মায়াভরা চোখ জ্বল জ্বল করে উঠত। গর্ব করে বলতেন- বাংলাদেশের যেখানেই যাও আমার ছাত্র ছাত্রী পাবেই। নীরবে নিভৃতে দিনের পর দিন প্রাণের অর্ঘ্য সমর্পণ করেছেন এই পাদপীঠে, তার সাধনা বয়ে এনেছে এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য। স্বপ্ন দেখেই তিনি ক্ষান্ত হন নি, স্বপ্ন পূরণ করে দেখিয়েছেন সবাইকে।
প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক সবার জন্য তার মনের দুয়ার ও তার ঘরের দুয়ার ছিল খোলা। শিক্ষকদেও শুধু সহকর্মী নয় বরং পরম সুহৃদ মনে করতেন। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আজ না ফেরার দেশ থেকে আমাদের প্রতিদিন দেখছেন, প্রাক্তন, বর্তমান সকল ছাত্র ছাত্রীর ছোট বড় সব প্রাপ্তির সাক্ষী হয়ে থাকছেন। তার একটা নির্বাক ছবি নতুন অডিটোরিয়ামের দেয়ালে, আর লাখো ছবি আমাদের
হৃদয়ে স্বপ্নের রসদ যোগায়। যার কাঁধে ছিল এত বড় প্রতিষ্ঠানের ভার, তার হৃদয় ছিল কাব্যরসে টইটম্বুর। স্কুল নিয়ে তার লেখা গানের লাইনগুলো আজো ছুঁয়ে যায় আমাদের-
আমাদের সুপ্রিয় রাইফেলস কলেজ নেইকো তার তুল
মোরা এখানে শিক্ষা লাভ করি, শত শত মুকুল ।
প্রথাগত জীবনের আটপৌওে স্বাধীনতা যখন ক্লান্ত করে তোলে, মন তখন আঁকড়ে ধরতে চায় ফেলে আসা দিনগুলোকে। কোন এক অলস দুপুরে সময়ের ধুলো ঝেড়ে স্মৃতিগুলোর হিসাব নিকেশ নিয়ে যখন বসি, স্কুলের সেই সোনালী দিনগুলো ফিরে আসে হৃদয়ের ডেস্কটপে।
রেজোয়ানা ইসলাম মুনমুন
এসএসসি-২০০২, এইচএসসি-২০০৪
শিক্ষক, ম্যাপল লীফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল
স্মৃতির রঙধনুতে লেখা দিনগুলি
বাংলাদেশ রাইফেল্স- সে এক অসাধারণ নাম, যা আজো আমার স্মৃতির পাতায় লেখা আছে। জীবনের প্রথম স্কুলিং এখানে না, তবুও এই কলেজের সাথে, এই জায়গাটির সাথে আমার অন্যরকম সম্পর্ক রয়েছে। আমার প্রিয় কলেজ। বাবার ব্যবসার কারণে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় আসা। সবেমাত্র নবম শ্রেণিতে উঠলাম। হঠাৎ করে নতুন একটা জায়গায় নতুন পরিবেশে এসে ভর্তি করলো আমাকে আব্বু। আমাদের প্রয়াত শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল স্যার মিয়া মো. মনিরুজ্জামান আমার বাবার বন্ধু মানুষ ছিলেন। আমাকে উনি সাদরে গ্রহণ করে নিলেন। আমি খেলাধুলা, শরীরচর্চা, গান, চিত্রাংকন, আবৃত্তি- এইসবে বেশ ভালই ছিলাম। স্যার তা জানতেন। উনি চাইতেন আমি যেন পড়াশোনার পাশাপাশি এইসব চালিয়ে যাই। নতুন পরিবেশ, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নতুন বন্ধু-বান্ধব- সব মিলিয়ে আমার খুব প্রিয় একটা জায়গাতে পরিণত হলো অল্প কয়দিনেই। আমার শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে বেশ ¯েœহ করতেন। এক কথায়, সবার আদরের ছিলাম আমি। সবসময় পড়াশোনায় নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। রাইফেল্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে বের হয়ে এসেছিলাম সেই ২০০২ সালে। এরপর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পাঁচটি বছর একটানা পড়াশোনা করার পর চাকরি-স্বামী-২টা বাচ্চা আর সংসারে আমার হারিয়ে যাওয়া। তেমন কারো সাথে যোগাযোগ ছিল না। ছিল শুধু বান্ধবী সেলিনা, পপি আর অসীম স্যারের সাথে যোগাযোগ। সব ভুলে গেলেও ভুলে যেতে পারি নি আমার প্রিয় রাইফেল্স কে।
আমার প্রিয় রাইফেল্স কলেজের কথা বলতেই প্রথমে একটা দৃশ্যপটের কথা মনে পড়ে যায়- বিশাল এক সুন্দর সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে শিক্ষার আলো নিতে আসা পাখিদের নীড় এই রাইফেল্স। ঠিক যেইরকম আমি চেয়েছিলাম, ঠিক ওইরকমই ছিল বড় মাঠ, বড় ক্লাসরুম। মোটকথা, সবুজের মাঝে আমি ছিলাম। যখন কালো মেঘে ছেয়ে যেত, ক্লাসরুমে আলো জ্বেলে আমরা বাইরের ঠা-া ঠা-া হিম হিম হাওয়ায় ক্লাস করতাম। তখনি হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজা মাটির গন্ধে মনটা বাইরের দিকে চলে যেতে চাইতো। শুধু মনে হতো কখন ছুটি হবে। আর আমি রাইফেল্স-এর আশপাশের সবুজে ঘুরে ঘুরে দেখবো। ঢাকা শহরের মাঝে এতো সুন্দর একটা পরিবেশ না দেখলে বোঝার উপায়ই ছিল না। আমার কলেজের পাশেই ছিল বিশাল এক পুকুর, খেলাধুলার মাঠ, ছিল গোলাপ বাগান, বাংলাদেশ রাইফেলস গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন হওয়ায় অনেক রুলস আর রেগুলেশনস-এর কারণে আমরা সব সময় সব দিকে বিচরণ করতে পারতাম না। যেতে চাইলে বলতো আংকেল ওইদিকে যাওয়া নিষেধ। অন্যদিকে যান। তখন রাগ হতো আমাদের। আরেকটি কথা না বললে নয়, ডিফেন্স-এর ইউনিফর্ম তখনি খুব কাছ থেকে দেখা আমার। খুব ভাল লাগতো। তখন মনে হতো, যদি ইউনিফর্ম পরতে পারতাম, তাহলে সারাজীবন এই খানেই থেকে যাওয়া যেত। যাই হোক আমার ডিফেন্সের ইউনিফর্ম পরা হয় নি। কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি একজন ডিফেন্স অফিসারকে। ও ডিফেন্সে থাকায় আমার নানা জায়গায় ঘোরা হয়। মজার ব্যাপার হলো, যে রাইফেল্স এর গেটে আমার পারমিশন নেয়া লাগতো আজ ওখানে যেতে আমাকে স্যালুট-এর মাধ্যমে সম্মান দিয়ে গ্রহণ করে নেয়। আমি গর্বে মাথা উচু করে যেতে পারি। যেখানে যাওয়া নিষেধ ছিল, সেখানেও যেতে কোনো বাধা নিষেধ নাই। কারণ আমিতো এখন ডিফেন্স পরিবারের সদস্য।
কিন্তু তখন যে আনন্দ ছিল লুকিয়ে লুকিয়ে না বলে এদিক সেদিক যাওয়ার, এখন ওই আনন্দটা কই? আমি খুব বেশি মিস করি সেই দিনগুলিকে। আমি সব সময় কৃতজ্ঞ থাকবো আমার প্রয়াত প্রিন্সিপাল মিয়া মো. মনিরুজ্জামান স্যারের প্রতি। কৃতজ্ঞ থাকবো, আমার সকল শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি, যাদের কষ্ট, ধৈর্য আর ভালবাসার কারণে আজ আমি নিজেকে একটা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আমি গর্ববোধ করি এই রাইফেল্স কলেজের এক্স-স্টুডেন্ট হতে পেরে।
এসএসসি-২০০০, এইচএসসি-২০০২
সিনিয়র আর্কিটেকচারাল ডিজাইনার, স্থপতি সংসদ লি.
ফিল্ম মেকার হবার পেছনে বিদ্যালয়ের ভূমিকা ওকিছু প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক কথা ...
লিখাটি শুরু করতে বসার পর পরই ঘুরে ফিরে একটা কথাই বারবার মাথায় আসছে: একটা কুকুর ‘কুকুর’ হিসেবেই জন্ম নেয় ; মারাও যায় কুকুর হিসেবেই। একটা বাঘ বা একটা বিড়ালের বেলায়ও তাই। এমনকি একটা সাপও জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সাপই, অন্য কিছু নয়। একটা সাপ ‘সাপ’ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কিন্তু জন্ম নেবার পর মানুষ ‘মানুষ’ হিসেবে থাকবে কি না তা বলা মুশকিল! মৃত্যুর সময়েও সে মানুষ হিসেবেই মৃত্যুবরণ করবে কিনা তা কেউই বলতে পারে না।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন গুরুজনরা বলতেন, ‘বাবা, মানুষ হও’। শুনে আমি অবাক হতাম! তাহলে কি আমি মানুষ নই? আমি তাহলে কী?
মানুষের আসলে সুবিধা অনেক। সে ইচ্ছে করলেই অন্যকিছু হয়ে উঠতে পারে! একটা কুকুর বা বেড়ালের সে সুযোগ বা ক্ষমতা নেই। একটা কুকুর ইচ্ছা করলেই হাতি হতে পারে না। একটা বিড়াল চাইলেই বাঘ হতে পারে না। মানুষ তার মুখের আদল অবিকৃত রেখেও তার স্বভাব বেশে হয়ে উঠতে পারে অন্য কিছু। এর জন্য তার মুখোশ দরকার পড়ে না।
আমার জানা মতে পরিবার হচ্ছে শিক্ষা গ্রহণের প্রথম এবং আদর্শ স্থান। আমার পরিবারের পরে আমাকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কারের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে আমার বিদ্যালয়ের ; তথা আমার শিক্ষকবৃন্দের। আমার বিদ্যালয়ের গৌরবের ৩০ বছর পূর্তিতে নিজের সশরীরে উপস্থিতি থাকতে পারাটা আমার কাছে অনেক গর্বের। গত ৩০ বছরে আমার বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্র-ছাত্রী পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি মাগফিরাত কামনা করছি। তাছাড়া অনেকে জীবন-জীবিকার তাগিদে পরবাসী হয়েছেন। বিদ্যালয়ের এই গৌরবের দিনে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা হয়তো সশরীরে আমাদের মাঝে উপস্থিত হতে পারে নি। তবুও আমি তাদের পরোক্ষ উপস্থিতি অনুভব করছি। আমার বিদ্যালয়ে আমি ‘দুরন্ত’ ছাত্র হিসেবেই চিিহ্নত ছিলাম। মাঝে মাঝে অনিয়ন্ত্রিত দুরন্তপনার কারণে প্রয়াত প্রধান শিক্ষক, পরে অধ্যক্ষ ‘মিয়া মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান’ স্যারের শাসনের সম্মুখীন হতে হতো। আজ বুঝতে পারছি স্যারের সেই শাসন আমাকে ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। লিখাটি যখন লিখতে বসি, তখন খুব আয়েশী ভঙ্গিতে নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করি, কিন্তু কখন যে স্মৃতিকাতর হয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে টেরই পাই নি। পেতামও না, যদি তার কয়েকটি ফোঁটা আমার লিখার খাতায় না পড়তো।
আমার এই ছোট্ট জীবনে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমাকে আজো স্মৃতিকাতর করে দেয়। তার মধ্যে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, আমার এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন, প্রথম কলেজে যাওয়ার দিন, প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, জীবনে প্রথম শূটিং-এর দিন, দুই বাংলার জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘মিরাক্কেল’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবার দিন ইত্যাদি। প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমি একজন নাট্য নির্মাতা। আশা করি, ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো। পেশা হিসেবে আমার পাসপোর্ট ও ফেসবুক প্রোফাইলে আমার পেশা ‘ফিল্ম মেকার’। যদিও-বা স্কুল/ কলেজ জীবনে নিজের পেশা হিসেবে রূপালি পর্দায় কাজ করাটা কখনও মাথায় আসে নি। হ্যাঁ, স্কুল জীবনে আমার প্রিয় বিষয় ছিল ‘সহ-শিক্ষা’, সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার শেষ ক্লাস ছিল সহ-শিক্ষা। ক্লাসটি অনেকটা ঐচ্ছিক থাকাতে অনেকে বাসায় চলে যেতো। ধীরে ধীরে আমার অনুরোধে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি বেড়ে যায়। আমি জানি না বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে আমার মত পেশার আরও দু’এক জনকে পাওয়া যাবে কি না। ব্যবসা, আইন পেশা, সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা, গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষকতাসহ অন্যান্য পেশার প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে আমার পেশা বড়ই মলিন। তবুও গর্বের সাথে একটি কথা বলতে পারিÑ ‘আমি এখনও আমার বিদ্যালয়ের সাথে সরাসরি জড়িত’। কিভাবে? বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত ভ্রমণ বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘চলো যাই অজানায়’ সার্কুলেশনের দায়িত্বে যে নামটা আছে আমি তার গর্বিত অধিকারী। আমার সাংস্কৃতিক জগতে বিচরণের প্রধান অনুপ্রেরণা বিদ্যালয়ের সেই ‘সহ-শিক্ষা’ ক্লাসের কিছু শিক্ষা। সেখানে সহ-শিক্ষার মানে জানতে পারি, বিনোদন বা ছোট খাটো খেলার মাধ্যমে জ্ঞানের বিকাশ সাধন করার নামই হচ্ছে সহ-শিক্ষা।

সেই অনুপ্রেরণা আজ আমাকে নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। যে বিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সহ-শিক্ষা নামক বিষয়ের মাধ্যমে এই শিক্ষা দেয় যে, ‘জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি সত্যিকারের মানুষ হওয়া অনেক জরুরি। আমি সেই স্কুলের একজন গর্বিত ছাত্র। তাই আজ নিঃসংকোচে বলতে পারি, আমার একজন নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য আমার পরিবার-পরিজনসহ অন্যান্য অনেকের মত আমার বিদ্যালয় তথা বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিশেষে আমার বিদ্যালয়ের সাবেক, বর্তমান সকল শিক্ষক, শিক্ষিকা এবং বিদ্যালয়ের ৩০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের সমন্বয়কারী সকল সদস্য, সদস্যাবৃন্দসহ এই লেখার সকল পাঠক-পাঠিকার প্রতি একটিই অনুরোধ রইলো: ‘ক্ষমা মহৎ গুণ’। তাই আমার লেখার অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আমার মত ক্ষুদ্র মানুষকে ধন্য করার পাশাপাশি নিজেদের মহৎ গুণকে সদা সমুন্নত রাখবেন।
শাহাদাৎ হোসেন জীবন (জীবন শাহাদাৎ)
এস.এস.সি ১৯৯৭
নির্মাতা ও পরিচালক
রউফ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের তথ্য সংগ্রহ করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। আপনার তথ্য জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ থেকে যারা ২০১৩ সনে ও ২০১৪ সনে েএসএসসি অথবা ২০১৫ সনে ও ২০১৬ সনে এইচএসসি পাশ করেছে প্রতিষ্ঠান থেকে তাদেরকে তাদের বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার তথ্য জানাতে আহ্বান করা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ এসব প্রাক্তন শিক্ষার্থীর তথ্য কলেজ থেকে প্রকাশিত বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘প্রতিভা’য় তুলে ধরবে। তাই যারা উল্লিখিত সনে উল্লিখিত ব্যাচের শিক্ষার্থী তাদেরকে এখানে তাদের তথ্য সাবমিট করতে অনুরোধ করা হলো।