রউফ কলেজ ‘৩০ বছর পূর্তি : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’


মনে পড়ে, খুবই মনে পড়ে। স্মৃতির কোঠায় জ্বল-জ্বল করে জাগরিত। মনে পড়ে আজ থেকে ৩০ বছর আগে পিলখানার এই সবুজ চত্বরে এক মাহেন্দ্রক্ষণে, অনাড়ম্বর পরিবেশে যাত্রা শুরু তৎকালিন বাংলাদেশ রাইফেল্‌স হাই স্কুল বর্তমানের এই বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের।
বাংলাদেশ রাইফেল্‌স-এর তৎকালিন  মহাপরিচালক র.আ.ম. গোলাম মোক্তাদির প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বিশেষ করে বিডিআর সন্তানদের শিক্ষার কথা বিবেচনায় রেখে হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনুভব করেন। এক্ষেত্রে তৎকালিন বিডিআরের এক শহীদ সদস্যের সন্তান জাকির হোসেন মিলন ও তার বন্ধুরা মাননীয় মহাপরিচালকের কাছে হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার নিবেদন জানালে তিনি সানন্দে হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করেন।

বাংলাদেশ রাইফেল্‌স-এর তৎকালিন উপ-মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার আইনুদ্দিন স্যার ও পরিচালক, যোগাযোগ কর্নেল মকবুল হায়দার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করায় যাত্রা শুরু হয় রাইফেল্‌স হাই স্কুলের। সময়টি ছিল ১৯৮৪ সাল। মাঠের একপাশে তাবু ঘেরা ছাউনিতে শুরু হয় প্রথম ক্লাস। প্রথম শিক্ষক হয়ে আসেন সহকর্মী এমডি মহিউদ্দিন স্যার। সেই থেকে পথ চলা শুরু।
ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মাত্র ১৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ১১ জন শিক্ষক নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয়টির গোড়াপত্তন হয়। ১ জানুয়ারি ১৯৮৪ থেকেই জুনিয়র হাই স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং একবছরের মধ্যেই এটি হাই স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৬ সালে ২৩ জন ছাত্র-ছাত্রী বিজ্ঞান ও মানবিক শাখায় প্রথমবারের মত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়-এরপর থেকেই ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়।


১৯৮৭ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন শিক্ষার জন্য নিবেদিত প্রাণ প্রয়াত মিয়া মো. মনিরুজ্জামান স্যার। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দিক নির্দেশনায় এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুতই উন্নতি লাভ করতে থাকে। ভাল ফলাফলের কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। গুরুত্ব বিবেচনা করে তৎকালিন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন, বিপি, পিএসসি প্রতিষ্ঠানটিকে কলেজে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাংলাদেশ রাইফেল্্স স্কুল ও কলেজ। ১৯৯৫ সালে তদানিন্তন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরী উদ্বোধন করেন স্কুলের প্রভাতি শাখার। ফলে কেজি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দুই শিফট শুরু হয় তখন থেকে। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ডিগ্রি কলেজে উন্নীত হয়। এ সময় থেকে প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ রাইফেল্‌স কলেজ করা হয়। ২০০৫ সালে বিডিআরের এক নির্ভিক সেনা মুক্তিযুদ্ধের অমর সৈনিক মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিকে চিরজাগরুক করে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দর রউফ রাইফেল্‌স কলেজ। ২০১১ সালে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠানটি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ হিসেবে বর্তমান নাম ধারণ করে।

ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই সকলের প্রত্যাশার পরিমাণ অনেক। সেদিক থেকে আমি মনে করি সঠিক পথেই এগিয়ে চলেছি আমরা। ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া ২৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয় ১৬ জন ; প্রথম বিভাগে মাত্র ০২ জন। কিন্তু এরপর থেকেই উন্নতির পথে আমরা এগিয়েছি দ্রুত গতিতে। ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে যথাক্রমে ৮১ ও ১০২ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। ২০০৭ সালে ঢাকা বোর্ডে ৪র্থ স্থান এবং ২০০৮ সালে আমরা ৯ম স্থান লাভ করি। গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের সার্বিক ফলাফল আরো উন্নত হয়েছে। বোর্ডের মেধা তালিকায় প্রতিবছর স্থান না হলেও পিইসি, জুনিয়র, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। আমরা ক্রমশঃ এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়েই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।


শুধু পড়ালেখার সাফল্যেই নয়, খেলাধুলাসহ অন্যান্য সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমেও আমাদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। অত্যন্ত সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় আন্তঃহাউজ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং বার্ষিক সাংস্কৃতিক ও মেধা পুরস্কার অনুষ্ঠান, এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও উৎসব পালিত হয় ঘটা করে। জাতীয়-আন্তর্জািতক চিত্রাংকন, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা, আন্তঃস্কুল-কলেজ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী, কুইজ, রচনা, সঙ্গীত-নৃত্য, জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক ও অন্যান্য বিতর্কে অংশগ্রহণ করে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর প্রচুর প্রচুর সাফল্য অর্জন করে আসছে। প্রতিবছর বিএনসিসি, স্কাউট, গাইডদের জাতীয়-আন্তর্জাতিক ক্যাম্প, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের কুজকাওয়াজ এবং ফিল্ড ডিসপ্লেতে অংশ নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের জন্য সুনাম কুড়িয়ে আনছে।

আজ কি নেই এ প্রতিষ্ঠানটির? টিনের চালাঘর থেকে যার যাত্রা শুরু আজ সেখানে বিশাল বিশাল ভবন, সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব-লাইব্রেরি, শিক্ষক লাউঞ্জ, অফিস কক্ষ ও সুরম্য অডিটোরিয়াম। আজ যখন চারদিকে তাকাই, মনটা ভরে যায় প্রশান্তিতে। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন আমাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। কত ডাক্তার, কত ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি অফিসার, ব্যাংক কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। মিডিয়ায় কাজ করছেন অনেকে। বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানিতে গুরু দায়িত্বে আছেন অনেকে। অনেকে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন অবস্থানে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। এইতো আমাদের প্রত্যাশা ছিল--- এইতো আমাদের প্রাপ্তি। অবশ্য প্রত্যাশার শেষ নেই, নেই প্রাপ্তিরও শেষ। আরো অনেক প্রত্যাশা যেমন আছে তেমন আরো অনেক প্রাপ্তির আশাবাদ। সবই বয়ে নিয়ে আসবে আজকের এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা- যারা একদিন হয়ে যাবে আমাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

সব প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝেও মনটা গভীর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে যায় যখন মনে পড়ে, টিনের চালাঘর থেকে আজকের এই বিশাল স্থাপনা-সুবিশাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে যে মহান ব্যক্তিটি ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন, নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন ; বড় মনে পড়ে তাঁকে। তিল তিল করে ক্রমশ মহীরুহে পরিণত করেছেন তিনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে। মহান শিক্ষাবিদ, শিক্ষার জন্য নিবেদিত প্রাণ, কবি, সাহিত্যিক অধ্যক্ষ মিয়া মোঃ মনিরুজ্জামানকে কি ভোলা যায়?

শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, প্রাক্তন সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রয়াত হাফিজ স্যার, তোফাজ্জল হোসেন স্যারকে। হারিয়েছি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একসঙ্গে কাজ করে আসা সহকর্মী বাংলা শিক্ষক মোঃ মিজানুর রহমানকে। আরো হারিয়েছি পাশের চেয়ারটিতে বসা ধর্মীয় শিক্ষক শাহ মোঃ আব্দুল মালেক স্যারকে। হারিয়েছি মোজাম্মেল হক আর খলিলকে। এই সাথে স্মরণ করছি কর্মজীবন থেকে অবসরে চলে যাওয়া সহকর্মীবৃন্দকে।

এসব শোকের কথা, হারানোর বেদনা! এসব নিয়ে আমরা শোকে মূহ্যমান, বেদনায় নীল হলেতো চলবে না। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেই সর্বদা আমাদের এগিয়ে চলা। আমাদের শক্তি, আমাদের প্রাণোচ্ছ্বল শিক্ষার্থীরা। যারা ছিলে, যারা আছো, যারা আসবে। আমরা এগিয়ে চলি তোমাদের তরে, তোমাদের পানে চেয়ে।



মোঃ আব্দুল জলিল
সিনিয়র শিক্ষক

* রউফিয়ানস রিদম, প্রথম সংখ্যা থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন