এ লেখা যখন লিখছি,
যখন সেটি ছাপা হয়ে প্রকাশ পাবে, তখন আমার বয়স একান্নোর কোঠা ছুঁই ছুঁই। সুদূর কানাডার
টরন্টো শহরে বসে লিখছি। তাগিদটা দীর্ঘকালের সহকর্মী নূরুল ইসলামের। রাইফেলস কলেজের
দীর্ঘ অতীত নিয়ে, সে অতীতের সাথে সম্পর্কের স্মৃতি নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ
নেওয়া হয়েছে। নূরুলের তাগিদে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ল্যাপটপে বসেছি কিছু লেখার জন্যে।
যে কর্মস্থলে যৌবনের চৌদ্দটা বছর পার করেছি, যেখানে আমার মননের নির্মিতি ঘটেছিল, সে
কলেজের তিরিশ বছর পূর্তিতে বই বেরুবে, আর তাতে আমার লেখা থাকবে না, তা তো হবার নয়!
তেমন বোধ থেকেই এ লেখার প্রয়াস।
শুরুতেই আমার
নিজেরই প্রশ্ন নিজের কাছে- কী নিয়ে হবে লেখাটা? যদি সেটি রাইফেল্স কলেজের ইতিহাস নিয়ে
হয় তাহলে সেটি লেখার জন্যে অনুপযুক্ত আমি। প্রথমত সন-তারিখের ব্যাপারে আমি কাঁচা। তাছাড়া
কলেজের ইতিহাস লেখার জন্যে সেখানে রয়ে গেছেন যথেষ্ট উপযুক্ত বেশ ক’জন পুরোনো মানুষ।
তাহলে কী নিয়ে হবে এ লেখা? সে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলেও কী-বোর্ড চালিয়ে যাচ্ছি।
দেখা যাক না! একটা জিনিস তো ঠিক, রাইফেলস কলেজ নিয়ে বই হবে, সেখানে আমি থাকবো না, তা
হতে পারে না! লেখার ভালো-মন্দের বিচার পরে করা যাবে। আগে লেখা...
আমি জানি লেখাটিতে
কলেজে আমার কর্মকালের স্মৃতিকথাগুলো ঢুকে যেতে পারে সহজেই। প্রশ্নটা হচ্ছে সে স্মৃতি
জেনে কার কী লাভ হবে? পাঠক হিসেবে বর্তমানে সেখানে যে শিক্ষকেরা কর্মরত আছেন, তাদের
কাছে আমার স্মৃতি হাতড়ানোর কোনো দাম আছে কি? পুরোনো যাঁরা, অর্থাৎ আমাদের সময়ে সেখানে
কর্মরত ছিলেন যাঁরা তাঁদের কাছে হয়তো একটা নস্টালজিক ভাব কিছুটা আসলেও আসতে পারে। আর
যাঁরা আমি সে প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে চলে আসার পর সেখানে প্রবেশ করছেন, তাঁদের কাছে এ
লেখার কোনো মূল্য আছে কি না আমি অনিশ্চিত।
তার চেয়ে বরং
আসুন নিজের ঢোল নিজেই পেটাই। কোথায় আছি, কী করছি এইসব আর কী। ঢোলের শব্দে হয়তো পুরোনো
জিনিস পরিস্ফুটিত হবে, অধিকতর মূল্যবান হয়ে উঠবে, যেমন এই মধ্যবয়সে এসেও দুর্গাপূজায়
ঢাকের বাদ্য শুনলে আমার মনে পড়ে যায় সেই কৈশোরকালের দিনগুলোর কথা। জন্মগ্রাম মছলন্দপুর
আর বেড়ে ওঠা বাজার কামারখালির কথা।
বলা যায়, যা যা
কাজ আমি করি, সবগুলোর প্রসঙ্গেই যে বোধিবৃক্ষের কথা আমার মনে আসে সেটি হলো রাইফেলস
কলেজ। এইসব মনে আসা প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই, আমি আসলে খুব স্বপ্নচারী মানুষ। খুব প্রেমিক
মানুষ। নতুন কাজের স্বপ্ন দেখলে সেটির প্রতি আমার প্রীতিটা এতটাই গভীর হয়ে যায় যে,
আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে যায় যেন। এমন কিছু স্বপ্ন নিয়ে টরন্টোতে আমার দিন চলা। তেমন সব স্বপ্ন
নিয়েই হয়তো আজকের এ লেখা।
কী সে স্বপ্ন?
যেমন নতুন আরও কিছু বই লেখার স্বপ্ন। পঞ্চাশ বছর ধরে নিজ মাতৃভূমিকে কেমন দেখলাম তাই
নিয়ে লেখার স্বপ্ন। নতুন দেশে নতুন সব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার স্বপ্ন। যুগে যুগে বাঙালি
কী চোখে মহাভারতকে দেখেছে তাই নিয়ে লেখার স্বপ্ন। কিছু বই বাংলা থেকে ইংরেজিতে করার
স্বপ্ন। হুমায়ুন আজাদের ‘ছাপান্নো হাজার বর্গমাইল’ বা সত্যেন সেনের ‘আলবেরুনি’ বা নাসরীন
জাহানের ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ অনুবাদের স্বপ্ন। আন্তসংস্কৃতির উপর একটা ইংরেজি
বই বাংলাতে করার স্বপ্ন। জাপান-বাংলা সম্পর্কের অতীত নিয়ে ইংরেজিতে একটা বই লেখার স্বপ্ন।
সে বিষয়ে বাংলায় বর্তমানের দুটোর সাথে আরও একটি যোগ করার স্বপ্ন। এছাড়াও রয়েছে সাহিত্য
নিয়ে আমার যে ওয়েবসাইট সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দীর্ঘকালের স্বপ্ন। অন্যদিকে টরন্টোর
তিন প্রবীণ বাঙালিকে দিয়ে তিনটি বই লিখিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন। আন্তসাংস্কৃতিক কাজের যে
প্রয়াস সে-বিষয়ক স্বপ্ন, যেমন ... যেমন ... আরও কতো কতো স্বপ্ন।
যেমন ফেব্রুয়ারির
৮ তারিখে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কারবরো ক্যাম্পাসে সম্প্রতি প্রয়াত কানাডার কার্লটন
বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা তেত্রিশ বছর অধ্যাপনা করা বাঙালি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান গণিতজ্ঞ
ড. মীজান রহমানের (১৯৩২-২০১৫) স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক বিরাট স¥রণসভা হলো। সে সভা আয়োজনের
জন্যে সাত সদস্যের যে কমিটি সেখানে আমাকে রাখা হয়েছিল। যে পাঁচজন মনস্বী এই অধ্যাপকের
জীবন ও দর্শনের উপর আলোকপাত করবেন সে তালিকাতেও আমি ছিলাম। এইসব কথা কেন বলছি? বলছি
এই কারণে যে, আমার এই অর্জনের পেছনে লুকিয়ে আছে যে শক্তি সেটি আসলে ওই রাইফেলস থেকেই
পাওয়া। রাইফেলস কলেজ আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল বলেই আমি স্বপ্ন দেখতে পারি, এই
বারো হাজার মাইল দূরে বসেও।
তাহলে টরন্টোতে
এ রচনার লেখকের শুরুর দিনগুলোর উপর খানিকটা আলোকপাত করে নেওয়া যাক। ভূগোলোকে বাংলাদেশের
উল্টোদিকে অবস্থিত এই মহাদেশটিতে আমি এসেছি মাত্র সেদিন, ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে, তাও
আবার মাসের অর্ধেক পেরিয়ে। আর টরন্টো এবং পাশ্ববর্তী শহরগুলো ছাড়া কানাডার অন্য কোনো
শহরে এখনও আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি, আমেরিকা তো দূরের কথা। উত্তর আমেরিকাতে অনেক বাঙালির
আবাস- এমন তথ্য বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় সকল অভিবাসীর মতো আমারও জানা ছিল। যদিও অনেক
শহরে যে বাঙালি খুবই কম তাও বুঝতে পেরেছি আসার আগেই। পেরেছিলাম কারণ, ইমিগ্রেশন ফর্মে
ডেশটিনেশন কলামে লিখেছিলাম- রেজাইনা-সাচকাচুয়ানের রাজধানী। ভিসা যখন কনফার্ম হয়ে এলো,
মাথা গেল খারাপ হয়ে। রেজাইনাতে তো বছরের আট মাসের বেশি মাইনাস ত্রিশের নিচে। মানুষও
থাকে খুব কম, বাঙালি থাকবে কোথা থেকে! আসার সময় এগিয়ে যায়, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারি
না এসে উঠবো কোন শহরে। সামান্য কয়েকজন বন্ধুই তো ভরসা। প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত চঞ্চল
সাহা, তার স্ত্রী মিতা সাহা, আর ছাত্র ইভান। আর তখনো পরোক্ষে বন্ধু আকবর হোসেন, সমরেশ
দাস, সওগাত আলী সাগর, সুজিত কুসুম পাল। ফাঁকে কি বলে রাখবো যে ওই ইভান কিন্তু রাইফেলস-এরই
প্রাক্তন ছাত্র? আইনকানুনের আগা-পাঁশ-তলা জানতে তাই ওদেরকে জ্বালাতে জ্বালাতে এক সময়
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, নাহ্ রিস্ক নিতেই হবে- টরন্টোতেই ল্যান্ড করি। অসুবিধা হলে
পরে দেখা যাবে। ১৫ আগস্ট নামার সময় তো বুঝি নাই কত সুধাই রেখেছে আমার নতুন দেশমাতা।
টরন্টো এবং সংলগ্ন
শহরগুলোতে, যাকে কিনা জিটিএ (গ্রেটার টরন্টো
এরিয়া) বলে তাতে বাঙালির সংখ্যা লাখখানেক। ওদিকে আরও খানিক দূরে দূরে গুয়েল্ফ, মিল্টন,
ওরোরা, ওশোয়া, লন্ডন প্রভৃতি এলাকাতেও বাঙালি আছেন যথেষ্ট। ঠিক দেড় বছরের মাথায় যখন
এ লেখা লিখছি আমি অনুমান করতে পারি সুদূরের এ শহরটিতে অন্তত হাজার দুয়েক বাঙালির সাথে
আমার দেখা হয়েছে। অন্তত একশোজন বাঙালি বন্ধুই হয়ে গিয়েছে অপরিচিত এ জায়গাতে। বাঙালি
আয়োজিত অন্তত পঞ্চাশটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। অন্তত বিশ-পঁচিশ জায়গাতে
আমি বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়েছি। মহাভারত নিয়ে নিজের লেখা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান দেখেছি
একটি বাংলা সাপ্তাহিকের উদ্যোগে। এই যে আমার সব-পারা তার সব বীজ অঙ্কুুরিত হয়েছিল যে
প্রাঙ্গণে সেটার নাম কিন্তু পিলখানা। ওখানে বসেই একসময় আমি লেখক হয়ে উঠেছিলাম। হয়েছিলাম
অনুবাদক, সম্পাদক। হয়েছিলাম সংগঠক, বক্তা। আদৌ সফল হয়েছি কি না সে প্রশ্ন ভিন্ন, কিন্তু
লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, সংগঠক এবং বক্তার সারিতে দাঁড়িয়েছি, সে বিষয়ে সন্দেহ কি!
তাহলে প্রথমে
লেখক হয়ে ওঠার কথাটা সেরে নেই। আমার কাজকে কারো সামনে তুলে ধরতে হলে আমার বইগুলোই তো
সবার আগে লাইন দিয়ে দাঁড়ায়! সেই ১৯৯৪ সালে কলেজে যোগদানের সময়ের কথা। এর আগেও আমি লিখতাম।
সাভার ক্যান্টনমেন্ট কলেজে যে ছয়মাস পড়িয়েছিলাম তখনই পত্রিকাতে আমার লেখা ছাপা শুরু।
যদিও সত্যিকারের শুরু আসলে আরও খানিক আগে। সেকালে ‘বাংলার বাণী’তে চাকরি করার সময় থেকেই।
প্রতি সপ্তাহের দুই চারটে দৈনিকের সাহিত্য পাতাতে লেখা ছাপা হতো আমার। রাইফেলসে এসে
সেটার গতি আরও বাড়লো। বাংলা ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখতে শুরু করলাম।
বাংলাদেশে যারা
ইংরেজিতে পড়াশোনা করেন, তাঁদের একটা বড়ো সমস্যা আছে। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা বিদেশি ভাষাতে
হওয়ায় তাঁদের ইংরেজি কিছুতেই পোক্ত হতে চায় না। হয়তো দেশীয় প্রেক্ষাপটে সেটি অনেকখানি,
কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই ইংরেজি বলা এবং লেখাতে লক্ষণীয়ভাবে দুর্বল। এমন ইংরেজিতে তাঁরা
কথা বলেন, যেটা ইংরেজিভাষীরা কখনোই বলেন না বললেই চলে। অন্যদিকে বাংলাটা ভালো করে শেখা
না হবার কারণে, বাংলা লেখাতে তারা দৃষ্টিকটুভাবে অপটু। আমার নিজের ক্ষেত্রেও সে দুটির
ব্যত্যয় ঘটে নি। অথচ মজার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো দুটি ভাষাতেই কলম ধরেছি আমি। ইংরেজি ঠিক
হতে থাকলো ব্যাকরণ বইয়ের সাহায্যে, বাংলা ঠিক হতে থাকলো সহকর্র্মীদের সহযোগিতায়। আব্দুল
আওয়াল মুসুল্লী আর আকমল হোসেন তাঁদের এই সহকর্মীকে নিরন্তর পরামর্শ দিতে থাকলেন। আওয়াল
নিজে কখনই কিছু লেখেন নি যদিও ; আকমল কিছু চর্চা করেছেন এদিক-সেদিক। ভাবলে মন খারাপ
হয় যে, পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও আওয়ালের কোনো বই হলো না এতোদিনেও।
এভাবে চার বছর
পার হয়ে যায়। বইয়ের কথা তখনও ভাবি নি। একদিন শুনলাম কলেজের কয়েকজন সহকর্মী নজরুল ইন্সটিটিউিটে
গিয়েছিলেন। সেখান থেকে নজরুল নিয়ে বই বের হবে। খুব মন খারাপ হলো। কলেজের একমাত্র নিয়মিত
লেখক হলাম আমি। আর আমাকে কেউ জানালোই না সংবাদটা। একা একা যোগাযোগ করলাম নজরুল ইন্সটিটিউিটে।
যা হবার নয় তাই হলো। সবার আগে আমার বই বেরুলো। অন্য কলিগদের মধ্যে মাত্র একজনের বই
পরে বের হয়েছিল, বাকিদের হয় নি। জানামতে, তাঁদের কারো কারো কোনো বই-ই অদ্যাবধি প্রকাশিত
হয়নি। বই প্রকাশ সেই যে শুরু, থামে নি আর। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে গোটাবিশেক। এমাজন কিল্ডলের
গুলো ধরলে পঁচিশ হয়ে গেছে আমার পঞ্চাশে।
অধ্যাপক জীবন
শুরু করেছিলাম কামারখালিতে। এমএ পরীক্ষা শেষ করে জন্মগ্রাম কামারখালীতে গেলে এলাকার
নেতৃস্থানীয় কিছু মানুষ এসে জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন কামারখালী বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর
রউফ ডিগ্রী কলেজে। মাত্র ছয় মাস কাজ করেছি সেখানে। পরবর্তীতে ভাবতে ভালো লাগতো যে একই
বীরশ্রেষ্ঠের নামের আরেক প্রতিষ্ঠানে এসে যুক্ত হয়ে গেলাম ঢাকাতে এসেও। সৌভাগ্যই বটে।
যা হোক, যা বলছিলাম।
শুরু হলো নতুন অভিবাসী বাঙালি, দেশেও কম পরিচিত এক লেখক সুব্রত কুমার দাসের টরন্টো জীবন। শুরু হলো সুযোগমতো এখানকার পত্রিকা
‘আজকাল’ আর ‘বাংলা কাগজ’ অফিসে ঢুঁ মারা। সেদুটোর সাথে সাথে ‘বাংলামেইল’-এও লেখা দিতে
শুরু করলাম। সাগরভাইয়ের অনলাইন ‘নতুনদেশ’-এ তো বাংলাদেশে থাকতেই লেখা দিতাম। শুরু হলো
বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু মন্দির এবং ধর্মাশ্রমে যাতায়াত। দুর্গাপুজোতে আরও গেলাম বার্চমাউন্টের
দুর্গামন্দিরে। রাইফেলস কলেজ থেকে যে লেখক হয়ে এসেছিলাম সেটাই আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু
হয়ে দাঁড়ালো। নিজের বই হাতে নিয়ে দাঁড়ালে আমাকে অস্বীকারের উপায় কী! মহাভারত হোক, রবীন্দ্রনাথ
হোক, নজরুল হোক Ñ আমাকে তাঁরা আদর করে ডাকেন। আমিও প্রাণের টানে দৌঁড়াই ওদের পানে।
টরন্টোর বাঙালি
এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ড্যানফোর্থের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, পত্রিকা অফিসে
আড্ডা দিতে দিতে, ফেসবুকে ঢুঁ মারতে মারতে নতুন দেশে আমার নতুন বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে
লাগলো। চিনে ফেললাম বাংলাদেশ সেন্টারের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে। দাঁড়িয়ে গেলাম রাস্তাতে
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। যে বিচার দাবি করে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি
থেকে আমাদের গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি, তেমন একটি শাহবাগ এখানে না থাকলেও সমচেতনার মানুষদের
সাথে একই আবেগে দাঁড়ানোর রাস্তা এদেশে পেয়ে ভাঙা হৃদয়ে জোড়া লাগল যেন। ধর্মীয় যে পরিচয়ের
কারণে, রাজনৈতিক যে চেতনার কারণে দেশে দিনযাপন অসাধ্য হয়ে উঠছিল, তা থেকে মুক্তি পেতে
থাকলাম ক্রমশ।
মনে পড়ে রাইফেলস-এ
যে যুক্ত হতাম বার্ষিক স্পোর্টস আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর সাথে, সে অভিজ্ঞতা নিজের
ভেতরে শক্তির সঞ্চারণ ঘটিয়েছিল। আমি নিজে তো গান গাইতে পারি না, আবৃত্তি করতে পারি
না, প্যারেড করাতে পারি না। কিন্তু যেটা পারি সেটা হলো, যাঁরা সেগুলো করেন তাঁদেরকে
একসাথে ধরে রেখে কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। এই পারাটাই আমার শক্তি হলো।
আমি কলার মানুষ।
চিন্তায় বিজ্ঞান থাকলেও, কাজের বিজ্ঞানে অজ্ঞান। তাই কম্পিউটারভীতি আমারও কম নয়। ১৯৯৭
সালের দিকে বাসাতে ভাঙ্গা এক কম্পিউটার তোলা হলো। শিক্ষার্থী অধিক মনোযোগী হওয়ায় মাস
না পেরুতেই সে কম্পিউটার হলো খান খান। এক আঙুলে টাইপ করতে করতে শিখলাম ই-মেইল করা,
সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ করা। সেই যে শুরু সেটার বাস্তবায়ন ঘটলো ২০০৩ সালে যখন ক্রোধী হয়ে
উঠেছিলাম একটা ওয়েবসাইট বানাতে যেখানে বাংলাদেশের সাহিত্য থাকবে। অক্টোবরের ২ তারিখে
ওয়েবসাইটের উদ্বোধন হলো। আবু দারদার মতো একজন সহকর্মী না পেলে কি সেই উদ্বোধন সম্ভব
ছিল? অনেক শিক্ষার্থী সে কাজে আমার শিক্ষকের ভূমিকাতে দাঁড়িয়েছিল। সেই সাইট এখনো আমার
প্রাণের অংশ, আমার অন্যতম পরিচয়। রাইফেলস-এর কালেই সে পরিচয় অর্জন।
সেই যে ২০০৬ সালে
বেশক’জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে মনডিয়ালোগোতে যুক্ত হলাম। ইউনেস্কো আয়োজিত আন্তসংস্কৃতিক
প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ৫০ জন শিক্ষকের একজন হলাম, রোমে গেলাম। পরের বছর
ওই ৫০ থেকে যখন শ্রেষ্ঠ তিনজনকে বাছাই করা হলো আমার দল এক নম্বর জায়গা পেয়ে চমকে দিয়েছিল
ইউনেস্কোর ফ্রান্স অফিসের অনেক কর্মকর্তাকে। সেই যে নতুন নতুন কাজের সাথে যুক্ত হয়েছি,
পুরস্কার কী পেয়েছি অন্যেরা তা জানেন না। কিন্তু আমি জানি- ওইসব কাজ আমার ভেতরে নতুন
কাজ করার উদ্যম দিয়েছে, নতুন কৌশলে কাজ করানোর যোগ্যতা দিয়েছে, নিজের ভেতরে সহনশীলতার
জন্ম দিয়েছে। ইউনেস্কোর সাথে আরও কতো কাজ করেছিলাম ওই বছরগুলোতে। সহকর্মী ও বন্ধু সুলতান
ফরিদ সাথে থেকেছেন নিরন্তর।
রাইফেলস-এই আমার
প্রাণশক্তির স্ফূরণ। সে স্ফূরণের চূড়ান্ত ঘটলো ২০০৮ সালে। ২০০৭ সাল থেকে জাপানের কোবে
ফুকিয়াই মিউনিসিপ্যাল স্কুলের সাথে কাজ করছিলাম। পরের বছর ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জাপানী
রাষ্ট্রদূত কলেজে এলেন। আমাদের কাজের কথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো আরও বেশি করে। সে সময়টাতেই
সহকর্মী নূরুল ইসলাম যেন নিজ পরিচয়কে আরও ঘনিষ্ট করে ফেললেন। জাপানের সাথে জাপান নিয়ে
ওই কাজই কিন্তু আমাকে জাপান-বাংলা সম্পর্কেও গবেষক করে তুলেছিল। সেই গবেষণার তাগিদ
এখনও আমাকে নতুন পাঠে ডুবিয়ে রাখে।
ইতোমধ্যে জমতে
থাকল সমালোচনার জঞ্জাল। কর্তৃপক্ষের গঞ্জনা। নতুন কাজের পথে পদে পদে বাধা। সিদ্ধান্ত
নিতে বাধ্য হলাম নতুন কর্মক্ষেত্র খোঁজার। কাজ যদি না করতে পারি তাহলে থেকে কী লাভ!
আর সেভাবেই ২০০৮ এর শেষ দিনটি রাইফেলস-এ আমার শেষ দিন হয়ে উপস্থিত হলো।
রাইফেলস ত্যাগ
কতোখানি ভুল ছিল সে বিতর্কে এ লেখাতে না যাই। কেননা, এরপর তো শুধুই বার বার বদলের ইতিহাস।
এক পর্যায়ে দেশ বদলের ভাবনা। সে ভাবনা থেকেই কানাডাতে ইমিগ্রেশনের দরখাস্ত করা এবং
একদিন পরিবার নিয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দেশত্যাগী হওয়া। একথা সত্যি, রাইফেলস না ছাড়লে
কানাডা আসা হতো না আমার।
নতুন দেশে, নতুন
পরিবেশ, নতুন ব্যবস্থায় অনেক কষ্ট থাকলেও, যা নেই তা হলো দগ্ধ হওয়ার কষ্ট। পুরোনো বন্ধু
একজনও না থাকলেও, বহু নতুন বন্ধুর অভাব হয় নি এখানে। ধর্ম নিয়ে শ্লেষ করার দুঃসাহস
কারো নেই এখানে। ৯১১ এ একটি ফোন কলই যে কোন মস্তানকে ঠা-া করতে সক্ষম এক মুহূর্তেই।
তাই, মাইনাস পঁচিশেও যেন কষ্টের ছোঁয়া স্পর্শ করে না আমাকে, যে কিনা জীবনের প্রায়
পঞ্চাশটি বছর কাটিয়েছে প্লাস পঁচিশের নাতি-তাপের সুখে।
বাংলাদেশে ২০১৪
সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর অত্যাচার নেমে আসলে কানাডাতে যখন প্রতিবাদী
মনের সঙ্গীর কোনো অভাব দেখি না, শহীদ দিবসে যখন শতশত বন্ধুর উচ্ছ্বাস দেখি, উদীচীর
অনুষ্ঠানে যখন মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীলতার জয়গান শুনি, তখন অনুভব করি, আমার চেতনা,
আমাদের চেতনার ধ্বজা উড্ডীন থাকবেই- দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকলেও সে চেতনা
অমলিন রাখবে এখানে তেমন সহযোদ্ধার কমতি নেই। যখন কোনো বন্ধু তাঁদের কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানে
যেতে নিমন্ত্রণ করেন, প্রত্যাশা করেন আমি তাঁদের সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হই, যখন কোনো
বন্ধু অল্প পরিচয়ের সূত্রেই আমাকে বুকে টেনে নেন, আমার বুঝতে বাকি থাকে না আমরা সবাই
বাংলাদেশ নামের দেশমাতৃকার সন্তান। যখন কোনো বন্ধু রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল নিয়ে আমার
গবেষণা নিয়ে আগ্রহ দেখান, একুশ নিয়ে আমার ভাবনা শুনতে বা আমার লেখা মহাভারত বিষয়ক গ্রন্থটি
নিয়ে উৎসাহ দেখান তখন বুঝি আমরা বিচ্ছিন্ন নই। আর যখন কোনো বন্ধু তাঁদের পত্রিকার পহেলা
বৈশাখ সংখ্যার জন্য আমার কাছে লেখা দাবি করেন, আমার সব শূন্যতা পূর্ণ হয়ে যায় মুহূর্তেই।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে যখন কোন বন্ধু আমাকে কিছু বক্তব্য দেওয়ার দাবি জানান
আমার সব অপ্রাপ্তি দূর হয়ে যায় এক নিমেষেই।
কেননা, আমি তো
জানি একজন বাঙালি হলেন তিনি যাঁর হৃদয়ে পহেলা বৈশাখ এবং একুশে ফেব্রুয়ারির উত্তাপ আছে,
আছে ধর্মনিরপেক্ষতার অহংকার, আছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মদানের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়ার
গর্ব। সেই উত্তাপ, অহংকার আর গর্বে আমরা টরন্টোর বন্ধুরা সকলেই সহযাত্রী- তেমন প্রত্যয়
নিয়ে নতুন দেশে আমার নতুন পথ চলা। সেই চলাতে অন্তরালে সাথী হয়ে চলে যে বোধিবৃক্ষ তার
নাম রাইফেলস। নিজেকে ধ্যানস্থ করে, সকলকে নিয়ে কাজ করার, সকলের জন্যে কাজ করার যে মন্ত্র
তা আমি শিখেছি ওই রাইফেলস কলেজ থেকেই।
২০১৪ সালের মার্চ
মাসে ঢাকাতে থেকেছি নিজের ৫০তম জন্মদিন উদযাপনের অনুষ্ঠানে। আমাকে নিয়ে, আমার কাজকে
নিয়ে ঢাউশ এক বই প্রকাশ করে আমাকে চমকে দিয়েছে যে কৃতী সে বরুণ-ওই রাইফেলস-এরই ছাত্র।
এর আগে আমার চিন্তা-চেতনা নিয়ে বই লিখেছে যে রাজিউল সেও আমাকে চিনেছে ওই রাইফেলস-এর
বন্ধুদের মাধ্যমেই। যে অলিভ তাঁর লেখা দুটি বই-ই আমাকে উৎসর্গ করেছে সে তো ওই প্রতিষ্ঠানেই
পাঠ নিয়েছিল। এভাবে নামের তালিকা করতে থাকলে পুরো লেখাটিতে হাজার হাজার এমন নামের অন্তর্ভুক্তি
সম্ভব।
যদি বেঁচে থাকি,
যদি আমার কোনো স্বপ্ন পূরণ হয়, আমি জানব সেই স্বপ্নের বীজ আমার অন্তরে পোতা হয়েছিল
ওই রাইফেলস-এর কালেই। যদি সামনের কোনো বইমেলায় নতুন কোনো বই হাতে নিয়ে দাঁড়াতে পারি
পাঠকের সামনে, সেও হবে রাইফেলস-এ থাকাকালীন আমার কোনো আরেকটি স্বপ্নেরই পূরণ। যদি টরন্টোতে
এমন কিছু করতে পারি যেটি বাঙালি কমিউনিটির জন্যে গর্বের হয়, তবে নিশ্চিত জানব যে, ওটির
গর্ভসঞ্চার হয়েছিল সুদূর অতীতে পিলখানার প্রান্তরে।
জীবনের ধরনই হয়তো
এমন যে, সে স্বপ্ন দেখবে যৌবনকালে। যৌবনের স্বপ্নগুলো ক্রমে ক্রমে পূরণ হতে থাকবে জীবনের
বাকি সময়গুলোতো। আমার এখন বাকি সময় চলছে। যে স্বপ্ন পূরণের সেগুলো দেখা হয়েছিল যখন
আমার যৌবনকাল, যে সময়টা আমি বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজে ছিলাম। ওই প্রতিষ্ঠানই আমাকে দিয়েছিল
হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাহচর্য। তাদের ভালোবাসা। সকল স্বপ্ন পূরণের শক্তির প্রকৃত
উৎস থাকে ভালোবাসাতে। রাইফেলস কলেজ আমাকে দিগন্ত বিস্তৃত সেই ভালোবাসাই দিয়েছিল।
সুুব্রত কুমার
দাস
প্রাক্তন শিক্ষক,
ইংরেজি; বর্তমানে কানাডা
প্রবাসী
* রউফিয়ানস রিদম, প্রথম সংখ্যা থেকে
* রউফিয়ানস রিদম, প্রথম সংখ্যা থেকে

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন