আত্মগত :
এ কোনো অধ্যাত্ম চেতনা উৎসারিত আকুতি নয়, নয় যক্ষ্মপ্রিয়ার বিরহী যক্ষ্মের সাথে মিলিত হবার কোনো প্রণয় আকাক্সক্ষা কিংবা কোনো পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার নির্বাণ সম্মিলনের উদগ্র প্রেষণা। প্রায় একযুগ ধরে ক্ষুণিœবৃত্তির তাড়নায় পরিযায়ী পাখির মতো দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছি। কখনো উত্তরের কুহেলী ঘেরা বাতাবরণ তো কখনো গাঙ্গেয় পলল বাহিত জলজ ছোঁয়ায় কম্পিত প্রহর, আবার বরেন্দ্র মৃত্তিকার ভঙ্গিল ভূমিরূপতা থেকে রক্তাক্ত জনপদে ভয়ার্ত বিচরণ। ফেরা হয় না প্রাণোচ্ছ্বল, উচ্ছ্বাসমুখর সবুজাভ তারুণ্যে, যৌবনদীপ্ত প্রগলভতায় কিংবা মন্দ্রিত সন্ধ্যার আলো আঁধারির নিমগ্নণ মায়ায়। সে মিলনের আকুতি থেকে আত্মগত ভাবনার ধূসর স্মৃতিময় প্রত্যাভিজ্ঞা। চেতনায় ফিরি না শরীরে না সত্তায়।
বন্ধুতা আর মিত্রতার সরলরৈখিক ধারায় বৈরি বিপন্ন আবহ যে উদ্ভূত হয় নি, তা নয়। অরিন্দমই, কে অদৃশ্য, অদৃশ্য অশুভ ছায়া খুঁজতে যাই নি কখনো, তবে যেখানে যতটুকু চন্দন চূর্ণের মতো সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-ভালবাসা মিলেছে তা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি প্রাণপণে। বিচ্ছিন্ন সত্তার হাহাকার গুমরে গুমরে কেঁদেছে অতীত উন্মীলিত অবারিত ছায়া সমাচ্ছন্ন নিবিড়তায়। তার কিছু অনুরণন মন্দ্রসপ্তকে আভাসিত।
ক্যান্ট-৮৬:
প্রতি বছরই বন্ধুরা একটি আয়োজনের ডালি সাজিয়ে আহ্বান করে সুখ সম্মিলনের কলকাকলিতে। গজারি বনের শ্যামলিমায় লাল মৃত্তিকার পায়ে হাঁটা মেঠোপথ আর শৈশব-কৈশোরের বর্ণিল উচ্ছ্বলতায় অবগাহন করতে মন যে চায় না তা নয়। দু’একবার সে স্বাদ গ্রহণ করা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবার আর যাওয়া হয় না। গত বছরের শেষার্ধেও এরকম সুখ-সম্মিলনের ডাক এসেছিল। মুখপুস্তিকায় বন্ধুদের আনন্দ অনুভূতি লাইক দিয়েছি, শেয়ার করেছি, সশরীরে একাত্ম হওয়া হয়ে ওঠে নি।
ডিসি -৮৮:
মুখপুস্তিকায় ঢাকা কলেজ-৮৮ ব্যাচের একটি পেজ আছে, মাঝে মাঝে সেখানে লাইক দিয়ে পরিচিত দু’একজন বন্ধুদের সাথে কিছুটা খুনসুটি হয় কিন্তু পুনর্মিলনী নামক সমাবেশে যেতে পারলাম না একবারও। খুব বেশি বন্ধুকে চিনি তাও নয়, দুই যুগ পূর্বের অনেক বন্ধুর চুলে পাক ধরেছে, কারো মাথার ঘন পিনদ্ধ চুলের বাহার আর নেই, কারো বা টাক মাথা- প্রযুক্তির কল্যাণে ভার্চুয়াল আনন্দ নেওয়ার চেষ্টা করি, এক হতে চেয়েও হয়ে ওঠে না।
যোগাযোগ -৯২:
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়া হয়েছিল দুই বছর, পেশায় জড়ানো হয়নি। প্রায়ই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বন্ধুরা ডাকে, যেতে চাই কিন্তু পারি না। মাত্র কিছু দিনের মধ্যে যোগাযোগ-৯২ এর বন্ধুরা পর পর দু’বার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সম্মিলিত হয়েছিল। কোনো ভাবেই সময় বের করতে পারলাম না। অথচ এসব বন্ধুদের সাথে কত আড্ডা, অনুভূতি, বাচালতা, দুষ্টামি জড়িয়ে আছে।
অনুভব -৯৩:
উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ধুকছি। একদিকে বেঁচে থাকার তাড়না অন্যদিকে জীবনের গতিপথ নির্ধারণের অপ্রত্যাশিত পথযাত্রা। কোথাও ভর্তির সুযোগ পাচ্ছি না। নানান মানুষ নানা ধরনের পরামর্শ দেয়। দূরে গিয়ে পড়াও সম্ভব নয়, আঁকড়ে থাকতে হবে ঢাকা শহর। অন্তত ট্যুইশনি করে হলেও টিকে থাকতে হবে। সাহিত্যের প্রতি ঝোঁকের কারণে কোথাও সুবিধা করতে না পারায় ভর্তি হয়েছিলাম বাংলা সাহিত্যে। পড়ে কি হবে এ দোলাচলে নষ্ট হলো একটি বছর, পুনরায় সে দেয়ালে মাথাকুটে মরার সাধ হয়। একঝাঁক অত্যন্ত মেধাবী, আড্ডাবাজ বন্ধুদের সাহচর্যে ডাকসু ক্যাফে, মধুর ক্যান্টিন, হাকিম চত্বর- মনে হতো বাপ দাদার সম্পত্তি। অনুভবের অনুভূতি দূরের বাতিঘর হয়ে জ্বলে, পরশমণি হয়ে স্পর্শ করে না।
পিলখানা -৯৫:
জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক চাকুরি বলতে যা বোঝায় তা শুরু করেছিলাম বাংলাদেশ রাইফেল্্স স্কুলে পিলখানার সবুজ ঘেরা নিবিড়তায় তিমির বিনাশী আলোক রশ্মি হাতে। তখন কি প্রাণোন্মাদনা। কচি কোমল কঠোর শিশু কিশোরদের সান্নিধ্য আমাকে অভিষিক্ত করেছিল মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমায়। আট বছরের কর্মজীবন আমাকে সারা জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দ আলোকে উদ্দীপ্ত করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইস্পাত কঠিন, প্রত্যয়ী, নির্মাণের কারিগরদের মাধ্যমে।
শেষের আগে:
পুনর্মিলনের আয়োজনে বার বার পিলখানা থেকে ডাক আসে। একবার গিয়েছিলাম তারপর বৈরী বিপন্ন কালাকাল- জ্বালাও-পোড়াও বারুদের ভেতর স্থানচ্যুতির মতো সাহস ও অনুমতি কোনটিই না থাকার কারণে অনিবার্য বিরহ। যেতে পারি নি স্মরণে বরণে সুহৃদ সাথীরা বিস্মৃতির খাতায় ফেলে দেয় নি। সে উপলক্ষে স্মরণিকায় আবার আামকে স্মরণ করেছে। দুবৃত্তায়িত সমাজ-সংকালে সামাজিক নিরাপত্তহীনতায় বেঁচে থাকা যেখানে প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা- সেখানে লিখবার মানসিকতা বিলাস মাত্র। তারপরও ঐ পুত পবিত্র ভূমিতে মনিরুজ্জামান স্যারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে-¯েœহাশিস ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।
মিলনের আকাক্সক্ষা চেতনার গভীরে রেখাপাত করে কিন্তু বার বার মনে হয়- মিলন হবে কত দিনে ? বন্ধু, স্বজন-আত্মজ যারা, তাদের অভিযোগের যৌক্তিক কারণ হয়তো আছে, আমি কি থাকি আমার মাঝে কিংবা আমি কি ধারণ করি আমাকে, নিজেই বুঝি না।
মনিরুল ইসলাম
প্রাক্তন শিক্ষক, বাংলা
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, রাণীনগর, নওগাঁ
* রউফিয়ানস রিদম, প্রথম সংখ্যা থেকে
* রউফিয়ানস রিদম, প্রথম সংখ্যা থেকে

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন