মেঘে
মেঘে গড়িয়ে গেল অনেক বেলা। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ এখন ৩০ বছরের
পরিপূর্ণ যুবক। আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগের এক কিশোর রাইফেল্্স স্কুল ও কলেজের সাথে
প্রথম মিতালি। যাঁর প্রণোদনায় আমরা এ প্রাঙ্গণে মিলেছিলাম তিনি আমাদের সবার প্রিয় অধ্যক্ষ
মিয়া মো. মনিরুজ্জামান স্যার। পিতৃসম শ্রদ্ধেয় স্যারের সুচারু দিক নির্দেশনায়, তাঁর
আদরে-শাসনে বেড়ে উঠেছিলাম আমরা। যার নির্যাস ছড়িয়েছিলাম কিশলয়দের। তাদের অনেকে এখন
বৃক্ষ। ভাবতে ভালো লাগে আজ এতো বিশাল এর পরিধি।
স্কুলে
ডে-শিফটে ছাত্র -পেটাতে যাঁরা ছিলেন ওস্তাদ, নিঃসন্দেহে আমি তাঁদেরই একজন। এখনো অনেক
পুরনো ছাত্র দেখা হলেই বলে ওঠে, ম্যাডাম আপনার লাল বেতটা কই? ... আমি যখন student ছিলাম
তখন আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল যে ছাত্রদের পিটিয়ে পিটিয়ে ব্যাকরণ শেখাবো। তার যথার্থ
প্রাপ্তি ঘটলো এ স্কুলে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রদের পড়িয়ে। কত দুষ্টু ছাত্র যে
পেলাম জীবনে! মার-টার খেয়ে কেমন করে যেন তারাই আবার প্রিয় হয়ে যেত। ছেলেরা আড়ালে আমাকে
‘রাখাল ম্যাডাম’ বলতো। কেননা আমিই ওদের বলতাম, তোরা সব গরু-ছাগল আর আমি তোদের চরাই,
সুতরাং...।
স্কুলের
আট বছরের মধ্যে প্রতি বছরই আমি ছিলাম, ‘শ্রেণিশিক্ষক’। ফলে আদ্যোপান্ত নাড়ি-নক্ষত্র
জানতেই হতো ছাত্রদের। একবার
অষ্টম শ্রেণির কিছু ছাত্র বাড়ি থেকে পালিয়ে দেশের বর্ডার এলাকায় গিয়ে বিডিআর কর্তৃক
ধৃত হয়ে স্কুলে ফিরে এলো। দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য যাই হোক আমি ছিলাম তাদের শ্রেণিশিক্ষক।
ফলে আমার ওপর দায়িত্ব পড়লো তাদের তদন্তের। একজন একজন করে কাছে ডেকে সবিস্তার কাহিনী
শুনে আমি তাদের অনেক কৌশলে পথে এনেছিলাম।
নবম
শ্রেণির কিছু বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র একবার এক বালিকার পাল্লায় পড়ে প্রায় গোল্লায় যাচ্ছিল।
শ্রেণিশিক্ষক হবার সুবাদে তাদের ফেরাতেই হলো। অবশ্য তাদের মায়েরা এবং অন্য ম্যাডামদের
গার্ড-অব-অনারে তারা শেষ পর্যন্ত গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছিল।
ছাত্ররা
জানতো, ম্যাডাম ক্লাসে অনেক কড়া। একবার এক ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আমাকে দেখে ভয়ে কাঁপছিল।
আমি হুংকার ছেড়ে বললাম, আমার চেহারা কি বাঘের মত? সে ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল- না, ম্যাডাম।
আমি বললাম, তাহলে তোর ভয়ের কারণটা কী? পরে দেখলাম তার ভয়টা ভেঙে গেছে। সুন্দর করে হেসে
সালাম দেয়। পরে একদিন তাকে লজ্জা দেবার জন্যই বললাম, ম্যাডামের চেহার আর বাঘের মত নেই
তো? সে উল্টে দৌড় লাগাল।
ক্লাস
সিক্স থেকে নাইন পর্যন্ত এই ভয়ংকর চেহারা অনেক কষ্ট করে ধরে রাখলেও টেন-এ গিয়ে ছাত্রদের
সাথে আসলে অনেক সখ্য হয়ে যেত। তবু আমি হলফ করে বলতে পারি শারফুন ম্যাডামের মার না খেয়ে
এসএসসি যারা পাশ করেছে তাদের সংখ্যা নগণ্যই। খুবই ভালো লাগে যখন দেখি সেসব চূড়ান্ত
দুষ্টু ছেলের দল একেকজন কত ভালো অবস্থানে আছে। কেউ কেউ ছিল খুব হ্যাংলা পাতলা গড়নের
এখন দেখি অনেক manly হয়ে গেছে। তাদের বিনয় আর ভদ্র চেহারা দেখে মুগ্ধ হই।
ছাত্ররা
জানতো আমি বাসায় পড়াই না। তাই একবার একদল দুষ্টু ছেলে, তারা পণ করলো আমার কাছে পড়বেই।
আমি ওদের অনেক ঘোরালাম, তবু দেখি একদিন ওরা আমার জিগাতলার বাসায় এসে হাজির। পড়াতে গিয়ে
হলো মহাবিপাক, কোনোভাবেই উপন্যাস আর নাটক তাদের দিয়ে পড়ানো গেল না। ম্যাডাম আপনি গল্প
বলেন, তাহলেই আমরা পাশ করবো।
ঠিক
এর উল্টোটি ঘটলো আরেক ভালো ছাত্রের বেলায়। আমি তাকে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম যে, আমার কাছে
পড়লে তুমি এ প্লাস পাবে না। সে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসতো, পড়া আদায় করে নিতো।
আমার বুকশেলফের বইগুলোর প্রতি ছিল তার অসীম কৌতূহল। রোজ রোজ সে আব্দার করতো ম্যাডাম,
কালকে অমুক চ্যাপ্টারের ওপর পরীক্ষা দেবো। আমি রাত জেগে তার জন্য প্রশ্ন তৈরি করতাম।
তার অতি আগ্রহেই শেষ পর্যন্ত সে এ প্লাস পেয়েছিলো। এতে তার জোর দাবী ছিল তার ছোট বোনকে
যেন পড়াই। অবশেষে তার থেকে মুক্তি পেলাম আমার সদ্যোজাত ছোট ছেলেকে দেখিয়ে।
কলেজে
আছি প্রায় আট বছর হলো। এবার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। ছাত্রদের মারতে পারি না কারণ তারা উচ্চতায়
আমার চেয়ে বড়। আর ছাত্রীদের মারি না, তারা দু’দিন পরে পরের বাড়ি চলে যাবে বলে। ফলে
সম্পর্ক হয়ে গেল অনেক বেশি আন্তরিক। ক্লাসে প্রায়ই আমি তাদের শ্রীমান/ শ্রীমতী বলে
গালি দেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এই গালির মানে তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয়।
এখন
আবার মর্নিং শিফটে ম্যাডামদের ভূমিকা অন্যরকম। আমাদের কড়া নজরদারিতে ওরা তটস্থ। আমার
মনে পড়ে, আমি গার্ল্স স্কুলে পড়াকালীন আমাদের ম্যাডামদের যেমন আমার শত্রু মনে হতো,
আমি Over sure যে আমাদের বালিকারাও আমাদের তাই মনে করে। আর class teacher হলে তো কথাই
আলাদা। Uniform থেকে শুরু করে আচার-আচরণ, পড়াশুনা সবকিছুতেই কেবল গুলি করি।
প্রযুক্তির
মাতামাতিতে আমি সবসময় ওদের পরামর্শ দেই প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করতে। যেই আমিই কি না
Facebok-এ বসে সময় নষ্ট করার জন্য ওদের বকা দেই, সেই আমিই আবার বলি, তোমরা Reunion এবং oublication-এর খবর জানো না facebook-এ দেখো না কেন? ওরা নিশ্চয়ই তখন বিভ্রান্ত
হয়। ওরা আরো যন্ত্রণায় থাকে যখন জানতে পারে ম্যাডামের facebook account না থাকা সত্ত্বেও
ম্যাডাম কিভাবে জানলো যে আমরা কে কে facebook-এ পড়ে থাকি! ছেলেরা নিশ্চয়ই তোমরা এতক্ষণে
রহস্যটা উদ্ধার করতে পেরেছো।
ভালা
থাকো সবাই। দোয়া করি - অনেক বড় হও তোমরা। সমস্ত শুভকামনা তোমাদের জন্য। আমরা তোমাদের
কাছে শুধু একটা সুন্দর প্রজন্ম চাই।
শারফুন
নাহার খান
প্রভাষক,
বাংলা
* রউফিয়ানস রিদম, প্রথম সংখ্যা থেকে
* রউফিয়ানস রিদম, প্রথম সংখ্যা থেকে

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন