গল্প: সমীকরণ



লেখক:  জন রাসেল




আমজাদ সাহেবের প্রচুর টাকা আছে। এই টাকার পরিমানটা ঠিক কত তা তিনি জানেন না, জানার কোন দরকারও মনে করেন না। ক’দিন ধরে তার মনে হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য এত টাকার কোন দরকার নেই। বেঁচে থাকার জন্য একজন মানুষের যতটুকু দরকার ততটুকুই থাকা উচিত। বাড়তি কিছু যদি তাঁর কাছে থাকে এর মানে হল সেটা অন্যজনের অংশ। কারো কাছে বাড়তি আছে মানে অন্যের কাছ থেকেই সেটা মাইনাস করা হয়েছে। একজনের যতটুকু প্রাচুর্য্য আরেকজনের ততটুকুই ঘাটতি।

আমজাদ সাহেব কিছু টাকা খরচ করার সিন্ধান্ত নিয়েছেন। কিভাবে খরচ করবেন তা বুঝতে পারছেন না। দেশে বিদেশে ঘোরা যায় ইচ্ছা করলে। ঘোরাঘুরি তার ভালো লাগেনা। একবার আমেরিকার ডিজনিল্যান্ডে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তার স্ত্রী খুব মুগ্ধ হলেও তিনি নিজে মুগ্ধ হতে পারেননি, পারার চেষ্টাও করেন নি। আরেকবার গেলেন কক্সবাজার। সেখানে নোংরা সি-বীচ দেখে তার বমি এসে গেল। তিনি দু’টি বমির ট্যাবলেট খেয়ে বাসায় চলে এলেন। সুতরাং এইসব বাদ। তিনি চাচ্ছেন টাকাটা এমনভাবে খরচ করবেন যাতে করে কিছুটা মানসিক আনন্দ পাওয়া যাবে।

গতকাল অফিস থেকে বের হবার সময় তার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে টাকা খরচ করার। প্রতি সপ্তাহে বৃহ¯পতিবার তিনি এমন একজন করে ব্যক্তির ইন্টারভিউ নেবেন যে খুব অদ্ভুত ক্যারেক্টারের।

বিনিময়ে এদেরকে দশ হাজার করে টাকা দিয়ে দেবেন। অদ্ভুত ক্যারেক্টারের লোকেদের সাথে কথা বলে কিছুটা মজা পাওয়া যেতে পারে। যদিও এদের যোগাড় করাটা ঝামেলার। কে অদ্ভুত ক্যারেক্টারের সেটা আগে থেকে বুঝা সম্ভব না। দূর থেকে যাদের অদ্ভুত ক্যারেক্টারের মনে হয় সামনে গেলে দেখা যায় এরা অধিকাংশই বদ্ধ পাগল।

অদ্ভুত ক্যারেক্টারের লোক জোগাড় করার দায়িত্বটা আমজাদ সাহেব তার ম্যানেজার মালেককে দিয়েছেন। মালেককে ডেকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কেমন লোকের ইন্টারভিউ নিতে চাচ্ছেন। মালেক খুব আগ্রহ করে সব শুনলো। শুনে দু’বার কান চুলকালো।

আমজাদ সাহেব কথা শেষ করে বললেন, হ্যাঁ মালেক এবার বল।

‘স্যার পুরো বিষয়টা আমার নলেজে আছে।’

‘নলেজে থাকলে হবেনা। লোক জোগাড় করতে হবে।’

‘হয়ে যাবে স্যার। আমি স্যার রাস্তা থেকে ধরে ধরে সব প্রতিভাগুলো নিয়ে আসব। স্ট্রীট প্রতিভা স্যার।’

২৮



‘প্রতিভা তো তোমাকে আনতে বলা হয়নি। অদ্ভুত ক্যারেক্টারের লোক আনবে।’

‘অবশ্যই স্যার। একদম ছেকে ছেকে অদ্ভুত ক্যারেক্টারেরগুলোই আনব। ছাকনি অভিযান হবে স্যার।’

‘গুড। যাও এবার।’

মালেকের উপর আমজাদ সাহেব খুব বেশি আস্থা রাখতে পারছেন না। কোথা থেকে কী ধরে নিয়ে আসবে কে জানে।

প্রথম বৃহ¯পতিবার মালেক এক ঝোলাওয়ালা লোককে নিয়ে এল। আমজাদ সাহেব সেই ঝোলাওয়ালার সাথে তিন মিনিটের বেশি ইন্টারভিউ চালাতে আগ্রহী হলেন না। ঝোলাওয়ালার সাথে কথাবার্তা যা হল:

‘আপনার নাম কী?’

‘আমার কোন নাম নাই জনাব। কাজেই পরিচয়। কর্ম পরিচয়ই আসল পরিচয়। মানুষের পরিচয় নামে না। নামে পরিচয় দিবে জ্বীন ভূত।’

‘ঠিক আছে। তো আপনি কী করেন সেটাই বলেন।’

‘আমি সাধনা করি। সাধনা বড়ই জটিল জিনিস জনাব। সাধনা হল ধ্যান।’

‘খুবই ভালো। আপনি কি পুরিয়া খান?’

‘জনাব, সাধনার জগত হইল ধোঁয়ার জগত। সেইখানে পুরিয়া ছাড়া কারো পক্ষে বিচরণ করা সম্ভব না। ধোঁয়া মগজে গেলে মনোযোগ আসে।’

‘তাহলে গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করুন। মনোযোগও আসলো আবার ক্যান্সারের ঝুঁকিও নেই।’

‘জনাব, এইসব বিষয় নিয়া রসিকতা করবেন না। এগুলা অতি সেনসেটিভ বিষয়।’

‘ও আচ্ছা। আপনি এখন আসুন তাহলে।’

‘এসেছি যখন যেতে তো হবেই। এটাই জগতের নিয়ম। একটা সিগারেট দেন। খেতে খেতে চলে যাই। গিয়ে সাধনার জগতে ঢুকতে হবে।’

আমজাদ সাহেব তার সিগারেটের পুরো প্যাকেটটাই দিয়ে দিলেন ঝোলাওয়ালাকে। ঝোলাওয়ালা সিগারেট ধরিয়ে ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে গেল।

মালেক এই বদ্ধ উন্মাদ লোকটিকে কী কারণে অফিসে নিয়ে এল আমজাদ সাহেবের মাথায় এল না। এর মধ্যে তিনি অদ্ভুত কিছুই পেলেন না। বাংলাদেশের প্রতিটি গলিতে গলিতে যেসব মাজার আছে সেগুলোতে গেলে এই শ্রেণির প্রাণী শয়ে শয়ে পাওয়া যাবে।

২৯



আজ বৃহ¯পতিবার, ইন্টারভিউর দিন। ইন্টারভিউ নেয়া হয় সন্ধ্যা সাতটা থেকে। এখন বাজে ছয়টা পঞ্চান্ন। আমজাদ সাহেব সিগারেট খাচ্ছেন তার অফিসরুমে বসে। তিনি বাসায় সিগারেট খান না। সিগারেটের গন্ধে তার স্ত্রীর মাথা ধরে। আর মাথা ধরলেই তার স্ত্রী ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে। সেগুলো শুনে তার নিজেরও মাথা ধরে যায়। সুতরাং বাসায় সিগারেট না খাওয়াই শ্রেয়।

সিগারেট শেষ হল। মালেক ইন্টারকমে তাকে জানালো যার ইন্টারভিউ নেয়া হবে সে এসে গেছে। আমজাদ সাহেব তাকে পাঠিয়ে দিতে বললেন তার রুমে।

যে লোকটি ঢুকলো তার বয়স চল্লিশের মত হতে পারে। গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, হাতে আদর্শলিপি বই। একে ঝোলাওয়ালার চেয়েও বড় পাগল মনে হচ্ছে। পাগল দেশে অনেক আছে এটা তিনি জানেন কিন্তু দেশে পাগলের মহামারী চলছে তা তিনি জানতেন না। মালেক গাধাটা খুঁজে খুঁজে পাগলগুলোই নিয়ে আসছে। থাপড়ানো দরকার। লোকটা এসে ফট করে চেয়ারে বসে পড়ল পারমিশন ছাড়াই। আমজাদ সাহেব বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন শুরু করলেন:

‘আপনার নাম কী?’

‘স্যার আমি, মোবারক।’

‘আপনার কাজ কী?’

‘আমি স্যার পথশিশু নিয়ে কাজ করি। এদেরকে টুকটাক অক্ষর শেখানোর চেষ্টা করি যাতে নিজের নামটা লিখতে পারে অন্তত।’

‘এই কাজটা কেন করেন? লাভ কী আপনার?’

‘লাভ জিনিসটা স্যার মোট দুই ধরনের হয়। একটা মানসিক আরেকটা আর্থিক। মানসিক লাভকে অনেকে লাভ মনে করেনা। সেভাবে চিন্তা করলে আমি এই কাজটি কোন লাভ ছাড়াই করি।’

‘দুই একটা পথশিশুকে অক্ষরজ্ঞান শিখিয়ে আদৌ কোন লাভ কি আছে? আপনার ধারণা এভাবে একদিন আপনি পুরো ষোল কোটি লোককে শিক্ষিত করে ফেলবেন?’

‘এটা স্যার আমার পক্ষে সম্ভব হবেনা। তবে এভাবে চালিয়ে যেতে পারলে কোন একদিন কেউ এসে এটা সম্ভব করবে। তাছাড়া ষোলকোটি মানুষের সবাই তো আর পথশিশু না।’

‘তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি মহাপুরুষ? জাতিকে অক্ষরজ্ঞান দান করার দায়িত্ব আপনি জোর করে নিয়েছেন? এই দেশে অবশ্য জোর করে দায়িত্ব নেয়ার কালচার নতুন না। রাজনীতিবিদরা জোর করে জনগণের সেবা করার দায়িত্ব নিয়ে থাকে এই দেশে। এমনকি জনগণ দায়িত্ব না দিলেও এরা নেয়।’

লোকটা চুপ করে রইলো। আমজাদ সাহেব প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলে অনেক সময় মানুষের আসল রূপ ধরা পড়ে। যে লোক অতিরিক্ত ন্যায় নীতির কথা বলে সেই লোক অধিকাংশ সময়ই টাকা পয়সা কিংবা নারী সংক্রান্ত কোন ব্যাপার এলে আগ্রহী হয়।

‘আপনার পরিবার কোথায় থাকে?’

৩০



‘আমি বিবাহ করিনি স্যার।’

‘এটা ভালো কাজ করেছেন। বিবাহ করা কোন সুস্থ লোকের কাজ না, মস্তিষ্ক বিকৃত লোকের কাজ। তাছাড়া ফ্যামিলি নিয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করাও সম্ভব না। ঠিক না?’

‘জি।’

‘আচ্ছা মোবারক সাহেব, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? আপনি কি বিশ্বাস করেন যে মানুষ তার প্রতিটি ভালো কাজের জন্য পরকালে পুরস্কার পাবে কিংবা আপনার এই মহান কাজের জন্য আপনি পুরষ্কার পাবেন?’

‘জি স্যার করি।’

‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের কিন্তু প্রমাণ নেই। ব্যাপারটা একটা অন্ধ বিশ্বাস ছাড়া কিছু না। ঠিক?’

‘জি স্যার।’

‘তাহলে কেন বিশ্বাস করেন?’

‘একটা বিশ্বাসের শক্তি অনেক স্যার। ধরুন, আপনি কাল কি করবেন সেই প্লানটা আপনি আজ করে রাখবেন। কারণ আপনি বিশ্বাস করেন কাল আপনি বেঁচে থাকবেন। আসলেই বেঁচে থাকবেন এমন কোন প্রমাণ তো আপনার হাতে নেই। তবুও আপনি এটা বিশ্বাস করছেন। এই বিশ্বাসই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখছে। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসটাও স্যার এমন। এই বিশ্বাস আমাদের ভালো কাজের জন্য পুরষ্কারের আশ্বাস দেয়। সেই আশ্বাসটা না থাকলে আমরা ভালো কাজ করতাম না।’

‘ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে আর কোন লাভ আছে?’

একটা বিশ্বাসের কারণে পৃথিবী বদলে যেতে পারে, অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়ে যেতে পারে। বিশ্বাস অসীম শক্তিধর জিনিস।’

‘সেটা কেমন?’

‘আফ্রিকাতে এক ধরনের ওঝা আছে যারা ভুডু, ব্লাক ম্যাজিক এসবের সাথে জড়িত। এসব ওঝারা মানুষের শরীর নিয়ে ভয়ংকর সব কাজ করে ফেলে কোন রকম বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করেই। এগুলো বিজ্ঞান কল্পনাই করতে পারেনা অথচ ভুডু পূজারীরা এগুলো করে ফেলছে বাস্তবে। এই ব্লাক ম্যাজিকটাও কিন্তু স্যার এক ধরনের বিশ্বাস নির্ভর ব্যাপার যেখানে কোন একটা অপশক্তি ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করে। অপশক্তি বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে ভালোশক্তি বলেও কিছু থাকবে। সেই ভালোশক্তিটাই স্যার ঈশ্বর।’

আমজাদ সাহেব কিছুটা চমকে উঠলেন। এই লোক কথার পিঠে কথা বলছে বেশ গুছিয়ে। মনে হচ্ছে আগে থেকেই সব রেডি করে এসেছে। ময়লা পাঞ্জাবী পরা লোকের কাছে এই যুক্তি প্রত্যাশিত না।

‘আপনার পড়ালেখা কতদূর?’

‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসফিতে মাস্টার্স করেছি।’

‘বলেন কী! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করে আপনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন?’

৩১



‘জি স্যার। কেউ কেউ রাস্তায় ঘুরবে, কেউ কেউ প্রতিদিন নয়টা-পাঁচটা অফিস করবে।

অফিসে বসে সে জীবন কাটিয়ে দেবে বাইরের জগতকে না দেখেই - এমনটাই হওয়ার কথা। জীবনকে একেকজন স্যার একেক জায়গায় খুজে নেয়।’

‘আচ্ছা, আপনি পথশিশু নিয়ে যে কাজ করছেন সেখানে আমি যদি কিছু ফান্ড দেই আপনি নেবেন? ধরুন, আমি যদি আপনাকে দশলক্ষ টাকা দেই পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার জন্য?’

‘দুঃখিত স্যার, আমি একাই কাজটা করতে চাচ্ছি। আমার ফান্ড দরকার নেই। পথে ঘুরে ঘুরে কাজ করার জন্য ফান্ড লাগেনা স্যার।’

‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে মোবারক সাহেব আপনি তাহলে এবার আসুন।’

‘আচ্ছা স্যার।’

মোবারক নামের লোকটা চলে গেল। আমজাদ সাহেব আরেকটি সিগারেট ধরালেন। তার টেবিলে সিগারেটের মোট দু’টা অ্যাশট্রে থাকে। দু’টাই বিদেশী। আজ একটাও নেই। সিগারেটে টান দিয়ে তিনি দুবার খক খক করে কাশলেন। নিজেকে হঠাৎ তার খুব তুচ্ছ মানুষ মনে হচ্ছে। এখন তার মনে হচ্ছে, তিনি যে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন এই টাকাগুলো আসলেই অন্য কারো কাছ থেকে মাইনাস হয়েছে। স¤পদের সুষম বণ্টন হয়নি। হলে পথশিশু বলে কিছু থাকার কথা না।

আমজাদ সাহেব মালেককে ডাকলেন। মালেক ছুটে এলো।

‘মালেক!’

‘জি স্যার।’

‘আমার খুব খারাপ লাগছে কেন জানি।’

‘কেন স্যার? ওই লোক আপনাকে কিছু বলেছে নাকি? আবার ধরে আনবো?’

‘না। ওকে আর আনার দরকার নেই।’

‘স্যারের শরীর অসুস্থ লাগছে? গাড়ি বের করতে বলব ড্রাইভারকে?’

‘শরীরের অসুখ তুচ্ছ জিনিস মালেক। অনেকদিন পর আজ আমার মন অসুস্থ। কিছু সমীকরণ আজ মিলছেনা। আচ্ছা মালেক তুমি নিজ চোখে ভয়াবহ খারাপ কোন মানুষ দেখেছ সামনা সামনি?’

‘স্যার আপনার প্রশ্নটা বুঝতে পারছিনা।’

‘তুমি আমার দিকে ভালো করে তাকাও। আমি একজন ভয়াবহ খারাপ মানুষ।’

মালেক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমজাদ সাহেবের দিকে। মালেকের কাছে মনে হল, সে জীবনে অনেক খারাপ মানুষ দেখেছে তবে সামনি সামনি কোন ভালো মানুষ দেখেনি। এই প্রথম সে নিজ চোখে একজন ভালো মানুষ দেখছে।



জন রাসেল, এইচএসসি-২০০৭, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ। কথাশিল্পী। প্রকাশিত গ্রন্থ: ২টি, অবেলা, পালক। ওয়ারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন