শিক্ষকতার মুড়িঘণ্ট





কী এক অদ্ভুত কারণে নবম শ্র্রেণিতে পড়া কালীন ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল, বড় হয়ে একদিন শিক্ষক হব। তাও আবার সরকারি কলেজে। বর্তমানে তা হতে পেরেছি বলে এখন বলাটা অনেকটা চাপাবাজির মত শোনাতে পারে। মনের গহীনে লুকানো বাঞ্ছাটি পূর্ণ হওয়ার মত পরিপূর্ণ বাস্তবতা অবগাহনের সুযোগ আমার মিল্লই বটে। ২৮তম বিসিএস এর সুবাদে এখন আমি আমার অভ্যন্তরীণ কল্পনার বাস্তব রাজ্যে বিচরণ করছি।  তবে, লোভী মনটা আর পারিপাশ্বিক চাপের কারণে অন্য কিছু যে হতে চাইনি, তা কিন্তু সত্যি নয়। মনের গহীনে অনেক রঙিন স্বপ্নের আনাগোনা কার না থাকে। বহুধা বিভক্ত স্বপ্নরাশি চতুর্দিক থেকেই তারা করত বটে। আবার কিছু উপ-স্বপ্ন, কিছু সহ-স্বপ্ন তো উঁকি মারত-ই। কখনও প্রশাসক, কখনও সংবাদ পাঠক হওয়ার ইচ্ছে জাগত। কখনও বা সিনেমার কমেডিয়ান। এগুলো বাহ্যিকতা বা পারিপাশ্বিকতা। অবশেষে দ্বিতীয় বার বিসিএস এ যখন আবারও শিক্ষা ক্যাডার পেলাম। তখন মনের ভেতরের মানুষটি আর বাইরের মানুষটির জন্য একই ধারা, একই সুর হয়ে শিক্ষকতাই হয়ে রইল কর্মযজ্ঞের এক রহস্যময় আধার।

রাইফেলস কলেজ : যেখানে যৌবন আমার




এ লেখা যখন লিখছি, যখন সেটি ছাপা হয়ে প্রকাশ পাবে, তখন আমার বয়স একান্নোর কোঠা ছুঁই ছুঁই। সুদূর কানাডার টরন্টো শহরে বসে লিখছি। তাগিদটা দীর্ঘকালের সহকর্মী নূরুল ইসলামের। রাইফেলস কলেজের দীর্ঘ অতীত নিয়ে, সে অতীতের সাথে সম্পর্কের স্মৃতি নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নূরুলের তাগিদে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ল্যাপটপে বসেছি কিছু লেখার জন্যে। যে কর্মস্থলে যৌবনের চৌদ্দটা বছর পার করেছি, যেখানে আমার মননের নির্মিতি ঘটেছিল, সে কলেজের তিরিশ বছর পূর্তিতে বই বেরুবে, আর তাতে আমার লেখা থাকবে না, তা তো হবার নয়! তেমন বোধ থেকেই এ লেখার প্রয়াস। 


শুরুতেই আমার নিজেরই প্রশ্ন নিজের কাছে- কী নিয়ে হবে লেখাটা? যদি সেটি রাইফেল্স কলেজের ইতিহাস নিয়ে হয় তাহলে সেটি লেখার জন্যে অনুপযুক্ত আমি। প্রথমত সন-তারিখের ব্যাপারে আমি কাঁচা। তাছাড়া কলেজের ইতিহাস লেখার জন্যে সেখানে রয়ে গেছেন যথেষ্ট উপযুক্ত বেশ ক’জন পুরোনো মানুষ। তাহলে কী নিয়ে হবে এ লেখা? সে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলেও কী-বোর্ড চালিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক না! একটা জিনিস তো ঠিক, রাইফেলস কলেজ নিয়ে বই হবে, সেখানে আমি থাকবো না, তা হতে পারে না! লেখার ভালো-মন্দের বিচার পরে করা যাবে। আগে লেখা...
আমি জানি লেখাটিতে কলেজে আমার কর্মকালের স্মৃতিকথাগুলো ঢুকে যেতে পারে সহজেই। প্রশ্নটা হচ্ছে সে স্মৃতি জেনে কার কী লাভ হবে? পাঠক হিসেবে বর্তমানে সেখানে যে শিক্ষকেরা কর্মরত আছেন, তাদের কাছে আমার স্মৃতি হাতড়ানোর কোনো দাম আছে কি? পুরোনো যাঁরা, অর্থাৎ আমাদের সময়ে সেখানে কর্মরত ছিলেন যাঁরা তাঁদের কাছে হয়তো একটা নস্টালজিক ভাব কিছুটা আসলেও আসতে পারে। আর যাঁরা আমি সে প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে চলে আসার পর সেখানে প্রবেশ করছেন, তাঁদের কাছে এ লেখার কোনো মূল্য আছে কি না আমি অনিশ্চিত।
তার চেয়ে বরং আসুন নিজের ঢোল নিজেই পেটাই। কোথায় আছি, কী করছি এইসব আর কী। ঢোলের শব্দে হয়তো পুরোনো জিনিস পরিস্ফুটিত হবে, অধিকতর মূল্যবান হয়ে উঠবে, যেমন এই মধ্যবয়সে এসেও দুর্গাপূজায় ঢাকের বাদ্য শুনলে আমার মনে পড়ে যায় সেই কৈশোরকালের দিনগুলোর কথা। জন্মগ্রাম মছলন্দপুর আর বেড়ে ওঠা বাজার কামারখালির কথা।


বলা যায়, যা যা কাজ আমি করি, সবগুলোর প্রসঙ্গেই যে বোধিবৃক্ষের কথা আমার মনে আসে সেটি হলো রাইফেলস কলেজ। এইসব মনে আসা প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই, আমি আসলে খুব স্বপ্নচারী মানুষ। খুব প্রেমিক মানুষ। নতুন কাজের স্বপ্ন দেখলে সেটির প্রতি আমার প্রীতিটা এতটাই গভীর হয়ে যায় যে, আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে যায় যেন। এমন কিছু স্বপ্ন নিয়ে টরন্টোতে আমার দিন চলা। তেমন সব স্বপ্ন নিয়েই হয়তো আজকের এ লেখা।