স্মৃতির পাতার অপরাধগুলোও রঙিন


শেরিফ আল সায়ার
এসএসসি ব্যাচ-২০০২
ইনচার্জ, গবেষণা বিভাগ, বাংলা ট্রিবিউন

BMARPC


লেখাটা শুরু করা নিয়ে বিপাকে পড়ে গেলাম। স্কুল জীবনের একগাদা স্মৃতি একাট্টা করার উপায় কি হতে পারে? স্কুল জীবনটা পার করে এসেছি ২০০২ সালে। পনের বছরের বেশি সময় পার করার পর যখন ওই জীবনের দিকে তাকাই তখন ঝাপসা ঝাপসা কিছু প্রলেপ স্মৃতির জানালায় দেখা যায়। 
বিচ্ছিন্ন কত্ত ঘটনা। কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার ঘটনা, কোনো স্যারের বেতের বাড়ি পাছায় খাওয়ার ঘটনা, পড়া না পারলে অপমান অপবাদের ঘটনাসহ আরও কত কি। 
এগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। কিন্তু তখন মনে হয়েছিল এই জীবনে কখনও ভুলবো না -‘ওমুক’ স্যার আমাকে নির্দয়ভাবে মেরেছে। কতো ক্ষোভ, কত অভিযোগের ঝোলা নিয়ে বের হয়ে এসেছি। কিন্তু এখন সেই ঝোলাটা কোথায়? কোথায় হারালো? ভাবছিলাম অভিযোগ করে কতো কি লিখে ফেলতে পারবো। কিন্তু ওসব এখন আর মনে নেই। 
তবে প্রশ্ন হলো মনে আছেটা কি? অনেক কিছুই তো দগদগে তকতকে করে জ্বলে ওঠে। বিয়ের পর আমার বউকে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি কখনও স্কুল পালিয়েছিলে? আমার বউ অবাক হয়ে বলে উঠলো, স্কুলে বদমাশরা পালায়।
অভাগা বউ আমার। একটা বদমাশ ছেলেকে বিয়ে করেছে। স্কুল পালানোর যে অ্যাডভেঞ্চারের মুহূর্ত সেই গল্প আমি হয়তো আমার ছেলেকেও শোনাবো। একবার বিখ্যাত অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যে মানুষটা স্কুল পালায়নি সে তো পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাকর মুহূর্ত মিস করে গেল।’ আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম এটারও তো জীবনে দরকার আছে। 
যাইহোক, দ্বিতীয় প্রশ্ন খুবই স্পর্শকাতর। “প্রেম”। আমার এক বন্ধু প্রায়ই একটা গল্প আমাদের শোনায়। সে নাকি জীবনে প্রথম প্রেমে পড়েছিল তার ক্লাসের কোনো এক টিচারের। বিষয়টা প্রথম শুনে অবাক হয়েছিলাম। বলে কি ব্যাটা? তারপর আরেকদিন সে বলেছিল, ম্যাডামকে নাকি পরীক্ষার খাতায় নিজের ভালোলাগার কথা বলেছিল! আমি কখনও তাকে প্রশ্ন করি নি তারপরের ঘটনা। একদিন খুব আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে বলল, ‘কী বলবে? ওই উত্তরে উনি দুটো শূন্য বসেয়েছিল।’ এরপর আর হাসি থামায় কে! 
কোনো ম্যাডামের প্রেমে পড়া তো অপরাধ না। কিন্তু ওই বয়সে ওই সময়ে প্রেমে পড়া অপরাধ। গুরুতর অপরাধ। এই প্রসঙ্গটা উল্লেখ করার পেছনেও কারণ আছে বটে। আমার প্রথম প্রেমে পড়াও তো স্কুলেই। ওই বয়সে প্রেমের মানে জানতাম না, এখনও জানি না প্রেমের মানে কি। কিন্তু আমার বোন তখন বলেছিল- ‘এটা প্রেম না, এটা ফ্যাসিনেশন’। 
ভাবছিলাম ছোট্টবেলার অপরাধগুলো নিয়েই লিখে ফেলবো। সেই উদ্যোগই ফাইনাল করলাম। দুটি অপরাধ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো। অনেকদিন পরীক্ষায় খাতায় মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা হয় না। এবার লিখা যেতে পারে। 
অপরাধ নং ১: 
স্কুল পালানো অপরাধ। এই অপরাধটি করতে আমাকে ক্লাস টেনের প্রিটেস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। টিফিন পিরিয়ডে দেয়াল টপকে স্কুলের সীমানার বাইরে। তারপর ভয়ে ভয়ে চারপাঁচজন হেঁটে হেঁটে রওনা দিলাম বিডিআর ৩ নম্বর গেটের দিকে। যেতেই দেখি শামীম স্যার রিক্সা দিয়ে আসছেন। খেলাধুলা নিয়ে শামীম স্যার তখন মহা ব্যস্ত। উনি দূর থেকে দেখে লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে গেলেন। আমার পাশের বন্ধু বলল, ‘হাঁটতে থাক। দেখি কি বলে।’ আমি বললাম, বলিস কি? স্যার তো প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নিয়ে যাবে মারতে মারতে। 
হুট করেই দেখি শামীম স্যার আমাদের দিকে দৌড় দিল। আমরা কী করবো? উল্টোদিকে দৌড় দিবো কিনা ভাবছিলাম। দেখি সবাই দৌড় দিল শামীম স্যারের দিকেই। ঘটনা শামীম স্যার কিছু বুঝে উঠতে না পেরে থেমে গেল। কিন্তু আমরা ততক্ষণে শামীম স্যারকে ক্রস করেই চলে গেলাম এক নতুন জীবনের আনন্দে। করলাম স্কুল পালানোর মতো অপরাধ। 
সেদিন সবাই মিলে গেলাম ধানমন্ডি লেকে। আমি কখনো ওখানে যাইনি। ওইটাই প্রথম। আমার বন্ধু তুহিন শুনে হাসতে হাসতে বলল, ‘বাহ্ এটা তো তোর স্ট্যাডি ট্যুর।’ সেদিন আমরা ঘুরে বেড়ালাম। বাসায় গেলাম। সারারাত শুধু একটাই আতংক। প্রথমত, টিফিন পিরিয়ডে লাল কালি পড়ার সম্ভাবনা। তাহলে মাইনুদ্দিন স্যার তো খবর করে ছেড়ে দেবেন। দ্বিতীয়ত, শামীম স্যারকে ক্রস করে এসেছি। স্যার তখন একটা কথা বলেছিল, কেউ শোনেনি। আমি শুনেছি। স্যার বলছিল, ‘সবকটার চেহারা চিনে রাখলাম’। সারারাত এক উত্তাল সময় পার করেছি। সারারাত বুকের ভেতর একটাই প্রশ্ন, কী হবে কাল?
পরদিন ভয়ে ভয়ে গেলাম ক্লাসে। গিয়ে শুনি টিফিন পিরিয়ডের পরের ক্লাসে রোলকল হয়নি। মনে হলো বিশ্বজয় করেছি। মনে হলো, অপরাধ করলে বোধহয় এভাবেই ছাড়া মিলে যায়। অপরাধে যে আনন্দ তার অনুভূতির স্বাদ নিলাম সেই প্রথম। কিন্তু অপরাধ চাপা থাকে না। দ্বিতীয়বারও করলাম। এবং ধরা খেতে হলো। মাইনুদ্দিন স্যার কিছু বলেনি শুরুতে। ক্লাস করালো। ক্লাস শেষে বলল, যে বিশ্বাস হারালি তা ফেরত পাবি না। 
মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর শাস্তি পেলাম। এক মানসিক যন্ত্রণায় কেটেছে কতগুলো দিন। বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি কিনা তা আর জানা হলো না। কিন্তু স্কুল পালিয়ে যে অ্যাডভেঞ্চারময় রাত কাটিয়েছি তা এখনও মনে করলে বুকটা আঁতকে ওঠে। পুরো ঘটনাটা ভাবলে নিজেই হেসে উঠি। মনে হয়- কী জীবন পার করে আসলাম? 
অপরাধ নং ২: 
দ্বিতীয় অপরাধ করেছি কিনা জানি না। তা নিয়ে সংশয় আছে। শুরুতেই কিন্তু বলেছি, ওটা নাকি ফেসিনেশন ছিল। আমি যখন ক্লাস এইটে তখন ক্লাস টেনের এক আপুকে দেখতে আমার অসম্ভব ভালো লাগতো। অসম্ভব কথা বলতে ইচ্ছে হতো। জীবনের প্রথম যে প্রেমপত্রটি লিখেছিলাম সেটা ওই আপুর বরাবর। ওনার নামটা বলা যাবে না। কেউ তাকে চিনুক তা তো আমি চাই না। যাইহোক, চিঠির শুরু করেছিলাম ‘প্রিয় আপু’ দিয়ে। পত্রটি দেওয়া হয়নি। সাহসে কুলায়নি। ওই চিঠি আমি অনেক বছর নিজের সঙ্গে করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম যেদিন ওনার সঙ্গে দেখা হবে আমি ওনাকে চিঠিটা দেখাবো। উনি কি মজাটাই না পাবে!! চিঠিটি এক সময় ফেলে দেই। 
আমি মামলা খালাস প্রকৃতির ছেলে না। ওনার কিছু স্মৃতি আমি নোটবন্দি করে ফেলেছিলাম। একদিন আমার একটা ডায়েরি দিয়ে লিখতে দিয়েছিলাম কয়েকটা প্রশ্ন। আপু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি এগুলো জেনে কী করবে?’ আমি বলেছিলাম, যাদের পছন্দ করি তাদের কাছ থেকে এই উত্তরগুলো স্মৃতি হিসেবে রেখে দেই। প্রশ্নগুলো খুব বাচ্চা টাইপ। প্রিয় ফুল, প্রিয় ফল, প্রিয় খেলোয়াড়, প্রিয় নায়ক ইত্যাদি। অর্থাৎ একজন মানুষের প্রিয় সব বিষয়গুলো রেখে দিলাম। মজার বিষয় হচ্ছে ওই ডায়েরিটা আজও আমার কাছে আছে। 
আমি এই মানুষটাকে অনেক খুঁজতাম। ইচ্ছে ছিল যেদিনই এই পরিণত বয়সে দেখা হবে সেদিনই আমি ওনাকে বিষয়টি বলবো। এই উত্তেজনার কিন্তু অবসান হয়েছে ২০১৩ সালে। মানে ১৯৯৯ সালে ওনাকে শেষ দেখেছিলাম। আর কথা হলো ২০১৩-তে। কতগুলো বছর, কত কাল, কত যুগ পার করে আসলাম। যখন কথা হলো তখন আমি অনেক অবেগ অনুভূতি নিয়ে পুরো ঘটনাটা ওনাকে বলি। ভাবছিলাম, ওনার কাছেও নিশ্চয় বিষয়টা অবাক লাগবে। প্রথম প্রশ্নটাই ছিল। ‘আমার এমন কোনো ঘটনাই মনে নেই। তুমি কে?’ 
একটু মন খারাপ করেই ডায়েরিতে ওনার লেখার ছবি তুলে ফেসবুকের চ্যাটিং বক্সে পাঠালাম। দেখেও যেন আপু নির্বিকার। শুধু একটাই উত্তর। ‘তাই তো এটা তো আমার হাতের লেখা। অবাক হলাম। ভালো থেকো।’ 
যে উত্তেজনা আমি ১ যুগ মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। তার কোনো ছিটেফোটাই পেলাম না। ওই ফ্যাসিনেশন তো এখন আর নেই। তবে আমি কেন যেন ওনার চোখে বিস্ময় আশা করে বসেছিলাম? সে উত্তর জানার চেষ্টা করা হয়নি। 
যাইহোক। ওই প্রেমে পড়ার অপরাধও আজ যেন মধুর। এই পৃথিবীতে মানুষের একপাশ থেকে প্রেমে পড়ার ঘটনা তো কম নেই। সেই কোটি কোটি গল্পের ভেতর আমার প্রথম প্রেম হারিয়ে গেছে। যা কাউকে কখনও বলা হয়নি। কিন্তু ওই সময়ে অপরাধ আজ যে বড় মধুর মনে হয়! এই মধুর মনে হওয়াও কি অপরাধ? 
ওই স্মৃতি মনে করে হাসি পায়। নিজেকে নিজে চেনা যায় না, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, ‘কোথায় তুমি হে কৈশোর? একবার এসে ধরা দাও।’ 
স্কুলের সংকলনে এই লেখা বাদও পড়ে যেতে পারে আবার সেন্সরডও হতে পারে। কিন্তু একটু মনের গহিনে ভেবে দেখো না। তোমার জীবনের অনেক কিছুই তো স্কুলেই প্রথমবার হয়েছিল। যা তখন ছিল অপরাধ, তা এখন হয়ে উঠেছে তোমার স্মৃতির পাতায় ঝকঝকে সুখের স্মৃতি। যা তোমাকে হাসাবে, যা ভেবে চোখের কোণের জল গড়িয়ে পড়বে। যা এই কঠিন বাস্তবতার মাঝে একটু শীতল অনুভূতি দেবে।


1 টি মন্তব্য:

  1. অনেক সুন্দর লেখা। লেখক আর আমি সমসাময়িক (২০০২ ব্যাচ) বলেই হয়তো আমি স্মৃতিগুলো নিজের সাথে রিলেট করতে পারছি। খুব মনে পরছে স্কুলজীবনের কথা। আহা কী সুন্দরই নাহ ছিলে সেই দিনগুলো !

    উত্তরমুছুন